১৯৯৬ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের মিলনপুর গ্রামের মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব নেন একই এলাকার বাসিন্দা নুরুজ্জামান। সেসময় ১০০ টাকা বেতনে শুরু হয় তার চাকরিজীবন। গত ২৮ বছরে তার বেতন বেড়ে হয়েছে মাত্র ৮০০ টাকা। বর্তমান বাজারে এই বেতন দিয়ে তার কিছুই হয় না। ইমামতির পাশাপাশি বাড়িতে তিনি ছোট একটি গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। সামান্য কৃষিজমি রয়েছে তার। সেখানে চাষাবাদ করেই চলছে তার জীবন। এছাড়াও একটি বীমা কোম্পানিতেও খণ্ডকালীন চাকরি করেন তিনি।
শুধু নুরুজ্জামান নয়, তার মতো একই অবস্থা জেলার অধিকাংশ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনের। সামান্য বেতনে চাকরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
মিলনপুর মসজিদের ইমাম মো. নুরুজ্জামান বলেন, সারা মাস ইমামতি করে ৮০০ টাকা পাই। কখনো এক হাজার টাকাও পাই। এই টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর গোশত ও এক কেজি মাছ কেনার সামর্থ্য হয় না। পরিবারে চারজন সদস্য। তার মধ্যে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলে লেখাপড়া করছে। ইমামতি করে যে টাকা পায় সেই টাকা দিয়ে সংসার চালানো কোনোভাবেই সম্ভব না। তাই অন্য কাজও করি। অন্যান্য পেশার বেতন বৃদ্ধি পায় কিন্তু ইমামদের বেতন বৃদ্ধি পায় না।
নুরুজ্জামান প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ক্বারিয়ানা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি মক্তবে কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং মসজিদে ইমামতি করে আসছেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, জেলায় মসজিদ আছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। যেহেতু শহর পর্যায়ের মসজিদগুলোতে ইমাম-মুয়াজ্জিন থাকে, কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে বেশিরভাগ মসজিদে একজনই সব দায়িত্ব পালন করেন। সে হিসাবে জেলায় ইমাম-মুয়াজ্জিনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার। কিন্তু এসব মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন খুবই কম। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী বেতন পান না অধিকাংশ ইমাম-মুয়াজ্জিন।
সদর উপজেলার বাসিন্দা আবুল কালাম (ছদ্মনাম)। দুই যুগ ধরে ইমামতি করছেন গ্রামের একটি মসজিদে। বেতন প্রতি সপ্তাহে ১০০-১৫০ টাকা। যা মাস গেলে ৭০০-১০০০ টাকার মতো হয়। ইমামতির পাশাপাশি নিজের কৃষিজমিতে কাজ করেন তিনি। সেখান থেকে সামান্য কিছু আয় হয়। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারে পাঁচ সদস্য। ছেলে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে লেখাপড়া করছে অনার্সে। ছেলের লেখাপড়ার পেছনে লাগে অনেক টাকা। এক মেয়ে নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। তার যে আয় তা দিয়ে অতিকষ্টে চলে সংসার। ঋণ করতে হয় মাঝে মধ্যেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে রীতিমতো লড়তে হচ্ছে তাকে।
তিনি বলেন, এদেশে ইমামদের কদর খুবই কম। আয়ও সামান্য। এই আয়ে সংসার চালানো খুবই কঠিন। আমি মসজিদ থেকে যে সম্মানী পাই তা থেকে বাজার খরচটা পর্যন্ত করতে পারি না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে থাকি। কঠিন বিপদের মধ্যে আছি আমরা। দাখিল (এসএসসি সমমান) পাস করে এই বেতনে চাকরি করা আমাদের এক ধরনের সম্মানহানি।
গড়েয়া ইউনিয়নের কেয়ারী গাও মসজিদের ইমাম হাফিজ উদ্দিন। তিনিসহ সন্তান নিয়ে ৬ জনের পরিবার তার। হাফিজ উদ্দিন মসজিদ থেকে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা পান। এ টাকায় তার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
তিনি বলেন, প্রতি মাসে সংসারের যে খরচ এই টাকা দিয়ে একবার বাজার করতে পারি। ১ বস্তা চাল কিনলেই টাকা শেষ। পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে আমি ওষুধের দোকান দিয়েছি। ফাজিল (ডিগ্রি সমমান) পাস করে একটি মসজিদে ইমামতি করে যেই টাকা পাই তা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। এই শিক্ষাগত যোগ্যতায় অনেক বেশি বেতনে চাকরি করেন অনেকে।
জগন্নাথপুর ইউনিয়নের পশ্চিম হাজিপাড়া মসজিদের ইমাম মো. ওয়াজেদ আলী। চারজনের সংসার তার। তিনি বলেন, মসজিদের ইমামের বেতন সামান্য। গ্রামপর্যায়ে একজন ইমামের বেতন এক থেকে দুই হাজার টাকা। বড় কোনো মসজিদ হলে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা হয়। অথচ বর্তমানে এক বস্তা চাল কিনতে তিন হাজার টাকা প্রয়োজন। পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল কিনতে গেলে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার প্রয়োজন। ইমাম হচ্ছে সমাজের নেতা। যার জন্য সমাজে সে চাইলেও যে কোনো ধরনের কাজ করতে পারে না। লোকলজ্জায় যেমন নীচু কাজ করতে পারে না, তেমনি মানুষের কাছে হাত পেতে কিছু চাইতেও পারে না। এভাবেই ইমামরা মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে। সরকার যদি কোনো বেতনের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে হয়তো মাদের ভাগ্যের উন্নতি হবে।
একই ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামের এক ইমাম নাম প্রকাশ না করে বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা আলেমদের কোনো খরচ নাই। কিন্তু সমাজের আর দশজন মানুষের মতো আমাদেরও যে পরিবার পরিজন আছে সেটা কেউ বুঝতে চায় না। এখনো আমাদের মাসিক বেতন দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। আর মুয়াজ্জিনকে দেয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। আপনারাই বলেন এই টাকা দিয়ে কোনো মানুষ কি বর্তমানে চলতে পারে। তবুও সব মহান আল্লাহর রহমত, আমরা সমাজে চলছি।
ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের গোয়ালপাড়া এলাকার বাইতুল ইসলাহ জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা জাকির হোসেন বলেন, শহরের অবস্থা কিছুটা হলেও ভালো, কিন্তু গ্রামের অবস্থা খুব বেশি করুণ। সেখানে বেশিরভাগ মসজিদের সব দায়িত্ব একজনের পালন করতে হয়। আবার মাস শেষে বেতনের জন্য গেলে উল্টো বলে বাকি দোকান ধরে মালামাল নিয়ে যান, আমরা পরিশোধ করব। আবার কোথাও মিলাদ বা দাওয়াত পেলে সেখানে কমিটিকে বলে যেতে হয়। কোনো কারণে নামাজের বা আজানের সময়ে যথা সময়ে উপস্থিত হতে না পারলে মন্দ কথাবার্তা বলে। কিন্তু এখন আমরা কোথায় যাব। তাই আল্লাহর ওপর ভরসা করে শত অপমান সহ্য করে রয়ে গেছি। তবে শান্তি এটুকু এলাকার মানুষ খুব ভালোবাসে।
সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের মিলনপুর জামে মসজিদ কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের হুজুরের (নুরুজ্জামান) বাসা মসজিদের পাশে এবং তিনি আমাদের এলাকার সন্তান। তাই তার বেতনের বিষয়ে তেমন একটি চিন্তা করা হয় না। সবাই মনে করে এলাকার ছেলে, বাসার পাশেই মসজিদ তাই নামাজ পড়াচ্ছে। বেতনের বিষয়টি কেউ কখনো গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করে না। তবে বর্তমানে প্রত্যেকটা জিনিসের যে হারে দাম বেড়েছে হুজুরের বেতন বৃদ্ধি করা দরকার।
জগন্নাথপুর খলিফাপাড়া মসজিদের সভাপতি রমজান আলী খান বলেন, আমাদের হুজুরকে আমরা চেষ্টা করি যথেষ্ট পরিমাণ সম্মানী দেওয়ার জন্য। আমাদের হুজুর একজন মাদ্রাসার শিক্ষক এবং উনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। উনি আমাদের এখানে জুমার নামাজ পড়ান এবং আমরা যেই বেতন দিয়ে থাকি তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।
জগন্নাথপুর পশ্চিম হাজিপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সদস্য মো. দুলাল মিয়া বলেন, আমাদের মসজিদের ইমামকে প্রতিদিন কোটার মধ্যে যে টাকা উঠে সেটাই আমরা দিয়ে থাকি। তবে এটা দিয়ে তার পরিবার চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কমিটির সদস্যসহ আমরা চেষ্টা করতেছি মসজিদের ইমামের জন্য ভালো কিছু করা যায় কিনা। তবে সরকার থেকে যদি ইমামদের বেতন চালু করা হতো তাহলে সবচেয়ে ভালো হতো। কমিটির সবাই এক রকম না। একেক জন একেক রকমের মতামত দিয়ে থাকে। সেই জন্য ইমামের বেতন বাড়ানোটা অনেকটা কষ্টের বিষয়। যার জন্য ইচ্ছা করলেও ইমামের বেতন বাড়ানো সম্ভব হয় না।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সাধারণত একজন আলেমকেই আমরা সমাজের আদর্শ মনে করি। কিন্তু সমাজের সেই আদর্শ ব্যক্তিটির আর্থিক স্বনির্ভরতা দরকার সেটা কেউ খেয়াল রাখে না। বরং কিছু অল্পশিক্ষিত লোক মসজিদ কমিটিতে গিয়ে আলেম সাহেবকেই নানাভাবে হয়রানি করে। আমি মনে করি বাংলাদেশের এখন সক্ষমতা বেড়েছে। যে দেশে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় একদিনের ষোষণায় সরকারি করতে পারে সেই দেশে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতনভাতা সরকারি তহবিল থেকে দিতে তেমন কষ্ট হবে না। উদ্যোগ নিলে সব কিছু সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু হলেও মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাতা দিতে শুরু করা দরকার।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শাজাহান বলেন, আমাদের আওতাধীন যেসব ইমাম রয়েছেন, তাদেরকে আমরা বেতনসহ বিভিন্ন ধরনের যে পাওনা রয়েছে সেগুলো সঠিক সময় দিয়ে থাকি। তবে সরকারিভাবে সারাদেশের ইমামদের বেতন চালু করার ব্যাপারে কোনো সুখবর নেই। বিভিন্ন এলাকার মসজিদ কমিটিতে যারা আছেন উনাদের প্রতি ইমাম-মুয়াজ্জিনদের যথাযত সম্মান করার আহ্বান জানাই।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের দপ্তরের একান্ত সচিব মো. বদিউজ্জমান বলেন, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় যা পাস করেন সেটাই বাস্তবায়নে আমরা দায়িত্ব পালন করে থাকি। এর বাহিরে আমাদের তেমন কোনো কিছু করার নেই। তবে সারা বাংলাদেশের ইমামদের বেতন চালু করার মতো তেমন কোনো সুখবর নেই।
সূত্র ও ছবি : ঢাকা পোস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।