বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : আমরা যখন প্রথমবারের মতো ফলাফলের দিকে তাকাই, রীতিমতো মাথা ঘুরে গিয়েছিল! কেবল এই একটিমাত্র জিনিস যেন আমাদের পরিচিত পৃথিবীর সভ্যতা ও মানুষের উদ্ভাবনীশক্তি সম্পর্কে সকল বোঝাপড়া নিয়ে আবার ভাবতে বাধ্য করে। আমরা কথা বলছি সত্যিকার অর্থেই দারুণ বুদ্ধিমান, অসাধারণ ও জটিল এক যন্ত্র নিয়ে; যা প্রাচীন গ্রিসে তৈরি করা হয়েছিল। বিশ্বাস করা কঠিন যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘কম্পিউটার’ গ্রিসে নির্মিত হয়েছিল।
বিবিসিকে এমনটাই বলছিলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের অধ্যাপক টনি ফ্রিথ। তিনি বলেন, প্রায় ১২০ বছর আগে গ্রিসের অ্যান্টিকাইথেরা দ্বীপের কাছে ভূমধ্যসাগরের নিচে একটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই যন্ত্রটি খুঁজে পায় ডুবুরিরা। বেশ বড় ধাতব এই যন্ত্রকে প্রথম দেখায় মোটেও আগ্রহোদ্দীপক কিছু মনে হয়নি ডুবুরিদের। ক্ষয়প্রাপ্ত এই ধাতব পিণ্ডকে নিয়ে কী করা যায়, সেটিও নিয়েও তৈরি হয়েছিল ধাঁধা।
টনি ফ্রিথ বলেন, ১৯০২ সালে যন্ত্রটি খুঁজে পাওয়ার পর পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা যায়, যন্ত্রটির গায়ে কয়েকটি গিয়ার সমন্বিত চাকা লাগানো রয়েছে। আর এতেই গবেষকরা দারুণ কৌতুহলী হয়ে ওঠে। কারণ, প্রাচীন গ্রিসে গিয়ার লাগানো চাকা থাকার কথা নয়। তার ওপর, ১ মিলিমিটার লম্বা খাঁজওয়ালা নির্ভুল চাকার অস্তিত্ব অনেক প্রতিষ্ঠিত ধারণাকেই সংশয়ের মুখে ফেলে দেয়।
প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিকাইথেরা মেকানিজম নামের এই যন্ত্রটি ধন্দে ফেলে দেয় প্রত্নতত্ত্ববিদ, গণিতবিদ থেকে শুরু করে আরও নানা শাখার বিজ্ঞানীদের। টনি ফ্রিথ বলেন, ব্রোঞ্জের তৈরি গিয়ার সম্বলিত চাকা দ্বারা ব্যবহৃত গণনাযন্ত্রটি দিয়ে নির্ভুলভাবে মহাবিশ্বের আবর্তন গণনা করা হতো। চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের গতি ও আবর্তনই কেবল নয়; চাকা ঘুরিয়ে ১০ বছর পরে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান কোথায় থাকবে তাও নির্ণয় করা যেত এই যন্ত্র দিয়ে।
কিন্তু প্রাচীন গ্রিসে এরকম একটি যন্ত্র কেন তৈরি করা হয়েছিল, এর জবাবে নির্ঘুম রাত কেটেছে অনেক বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদের। টনি ফ্রিথ এ সম্পর্কে বলেন, আমার ধারণা, তাদের কাছে জ্যোতির্বিদ্যাসংক্রান্ত যেসব সূত্র ছিল তার প্রয়োগ এই যন্ত্রের মাধ্যমে করা যেত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসবই হতো চাকা ঘুরিয়ে। তারা জানতে চাইতো, আগামীর মহাবিশ্ব কেমন হবে; পাঁচ বছর পর চাঁদ কোথায় থাকবে। আর চাকা ঘুরানোর সাথে সাথেই এমন জটিল প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেত। নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে এই যন্ত্রটি ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।
গ্রিসের মিউজিয়ামে ৮২ ভাগে রাখা হয়েছে এই অ্যান্টিকাইথেরা মেকানিজম। এর অনেক অংশই হারিয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে অনেকাংশেই বলা যাচ্ছে যে, ২ হাজার বছরের পুরনো এই যন্ত্রটিতে আসলে কী কী ছিল। ১৯৭০ সালে এক্স-রে ব্যবহার করে কয়েক ডজন খাঁজকাটা চাকার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। তখনও থ্রিডি এক্স-রে না থাকায় খাঁজগুলোকে আলাদা করা সম্ভব হয়নি।
টনি ফ্রিথ বলেন, এথেন্সে ৮ টনের একটি এক্স-রে মেশিন নিয়ে যাই আমরা। জাদুঘরে সেটি বসিয়ে যন্ত্রটির টিকে থাকা ৮২টি ভাগের এক্স-রে ডাটা লিপিবদ্ধ করা হয়। এর ফলাফলই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এবার গিয়ার সম্বলিত চাকাগুলোতে ত্রিমাত্রিক বিন্যাসে দেখো গেল। তাতে খাঁজগুলোকে আলাদা করাও যেমন সম্ভব হয়েছে, তেমনি যন্ত্রাংশে বিদ্যমান শিলালিপিও চোখে পড়েছে প্রথমবারের মতো। নতুন এক রহস্যের দুনিয়া উন্মোচিত হলো যখন ক্ষয়প্রাপ্ত ব্রোঞ্জে পাওয়া গেল প্রাচীন নির্দেশনা। সাম্প্রতিক দশকগুলোর আবিষ্কারে বেরিয়ে এসেছে, এই যন্ত্র সূর্যগ্রহণ ও চাঁদের পরিবর্তনশীল গতির নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতো।
পূর্বের বিশেষজ্ঞরা যন্ত্রটির পেছনের অংশের প্রতিলিপি খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু প্রাচীন শিলালিপির নির্দেশনা অনুসারে ফ্রিথ ও তার সঙ্গীরা যন্ত্রটির সামনের অংশের প্রতিলিপি তৈরিতেও সক্ষম হন। হাজারের বেশি প্রাচীন গ্রিক হরফ দেখালো, কীভাবে যন্ত্রটি কাজ করতো। অনেকটা ‘রিং সিস্টেমে’ সেখানে বর্ণীত হয়েছে গ্রিক মহাকাশ।
টনি ফ্রিথ বলেন, এটি প্রযুক্তির ইতিহাসকে অনেক আগের সময়ে ফিরিয়ে এনেছে। এটা বিস্ময়কর যে, প্রথমে প্রযুক্তি তৈরি করে তারপর একে যন্ত্র রূপ দেয়ার ধারণা ছিল প্রাচীন গ্রিকদের। তাই এই একটি যন্ত্রের কারণেই আমি মনে করি, প্রযুক্তির ইতিহাসকে নতুন করে জানা জরুরি।
আর্থার সি ক্লার্ক বলেছিলেন, গ্রিকরা যদি তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পর্কে জানতো তবে ৩০০ বছরের মধ্যে চাঁদে পদার্পণ করা তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই হতো না। এখন মানুষ তার নিকটবর্তী নক্ষত্রের ব্যাপারে খোঁজখবর করতে পারেন। টনি ফ্রিথের দল এখন গ্রিকদের অনুসরণে তত্ত্বীয় জায়গা ঠিক করে যন্ত্রটির ভৌত কাঠামো তৈরির কাজে লেগেছে।
টনি ফ্রিথ বলেন, অ্যান্টিকাইথেরা মেকানিজম সাক্ষ্য দেয়, প্রাচীনকালে এমন আরও যন্ত্র ছিল। হয়তো ভূমধ্যসাগরের গভীর তলদেশে লুকিয়ে আছে সেসব। তবে সাগরের তলদেশ থেকে ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার প্রযুক্তিও এখন দারুণ উন্নত। প্রযুক্তিগত যে উৎকর্ষতা এখন আমরা ভোগ করছি, তার স্বরূপ নির্ণয়ের জন্য বিবর্তনও আমাদের জানতে হবে। কে জানে, কেবল সামনে না, সময়ের প্রবাহ ধরে পেছনে গেলেও হয়তো নতুন কিছু পাওয়া যায়!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।