জুমবাংলা ডেস্ক : ড. কামরুল হাসান মামুন: শিক্ষা খাতে ৩টি দুঃসংবাদ: [১] জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলো জেলা ও বিভাগের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাচ্ছে। [২] এখন থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে। [৩] সংশোধিত এডিপিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় ‘কোপ’।
শিক্ষা নিয়ে আমাদের কোনো ভালো সংবাদ নেই। যা কিছু সিদ্ধান্ত হয় কেবল আরো অধঃপতনের দিকে ত্বরান্বিত করছে। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমতো মূল ধারার শিক্ষাকে পুরো ধ্বংস করে দেবেই। এতো প্রতিবাদ, এতো কথা তবুও সরকার নাছোড় বান্দা ‘পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই’ এর মতো এই বিশাল ক্ষতির প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বলেই গোঁ ধরেছে। ঢাকার ৭টি বড় বড় কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধীনে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নামিয়ে দিয়েছে। এখন বাকি যেই বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেগুলোর দিকে নজর গিয়েছে। কলেজগুলোর মান একটু বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নামবে। এমনিতেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণার মান খুব খারাপ। এর ওপর এগুলোর ঘাড়ে কলেজ চাপিয়ে দিলে এদের মান আরো খারাপ হবে। কলেজের গড় একটু বাড়াতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কমানো জাতির জন্য কি আদৌ মঙ্গলজনক হবে? একদম না। তাও যদি কলেজের মান অনেক বাড়ানো যেতো তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারতো।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু গবেষণা করে দেখা উচিত ছিলো ঢাকার ৭টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কি বৃদ্ধি পেয়েছে বা এতে কি আদৌ দেশের লাভ হচ্ছে? যেই বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের ভার বহন করতে পারছিলো না সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে তার নিজের সমান আরো ৭টি প্রতিষ্ঠানকে চাপিয়ে দিয়ে কীভাবে তার মান বৃদ্ধি পাবে? আমি এখন ৭ কলেজের একটি বর্ষের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি। আমি টের পাচ্ছি আমার উপর দিয়ে কি তুফান যাচ্ছে। ওদের পরীক্ষার প্রশ্ন করা, মডারেশন করা, প্রশ্নপত্র ছাপানো ইত্যাদিতো আছেই তার ওপর ৭ কলেজের ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য বহিরাগত পরীক্ষক পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন আমার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষককে ৭ কলেজের একাধিক কলেজে দৌঁড়াতে হয় যার ফলে ওই শিক্ষকদের পক্ষে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্ভিস দিতে পারছে না। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ওই শিক্ষকদের সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ওই শিক্ষকরা নিজের লেখাপড়া ও গবেষণা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই গল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বিভাগের। ৭ কলেজের এসব কাজ করে শিক্ষকরা কিছু টাকা পয়সা পাচ্ছে এই লোভে অনেক শিক্ষক এটার পক্ষেও। কিন্তু বড় পর্দায় রেখে দেখলে এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মোটেই উপকারী নয়।
পশ্চিমবঙ্গের অনেক কলেজও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তার কুফল তারা ভোগ করছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্টারেংকিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও পেছনে। মনে রাখতে হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডার গ্রাজুয়েট নেই। আছে কেবল মাস্টার্স আর পিএইচডি প্রোগ্রাম। কলেজগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হওয়া সত্ত্বেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কলেজগুলোর পরীক্ষার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত না। অর্থাৎ পরীক্ষার প্রশ্ন করা থেকে শুরু করে ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো কলেজগুলোই নেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সার্টিফিকেট দেয় আর ওভার অল সুপারভাইস করে। পৃথিবীর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন কি করে? সর্বদা চেষ্টা করে কি করে তার শিক্ষকদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। তারা চেষ্টা করে যেই কাজ একজন কম শিক্ষিত ও কম যোগ্য মানুষদের দিয়ে করানো যায় সেই কাজ তারা তাদের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষকদের দিয়ে করায় না। তার জন্য তারা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট নেয়, পার্ট টাইম ও adjunct শিক্ষক নিয়োগ দেয়। আমরাতো তা করছিই না উল্টো আমাদেরকে দিয়ে নিজ বিভাগের বাহিরে ৭টি কলেজের ঘানি টানাচ্ছে।
আরো একটি দুঃসংবাদ হলো এখন থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে। এটা শেষমেশ কাদের ঘাড়ে পড়বে? আমরাতো আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিনি। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাদের মালিক আছে এবং মালিকরা নানাভাবে মুনাফা নেয়। এখন কি মালিকরা মুনাফা নেওয়া কমিয়ে দিবে? মোটেও না। তারা ট্যাক্সের টাকাটা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আদায় করবে। এর মানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া আরো ব্যয়বহুল হবে। দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সরকারতো দায়িত্ব পালন করছেই না উল্টো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাক্স বসিয়ে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা আরো বিদেশগামী হবে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আরো বেশি হারে বিদেশে চলে যাবে। শুধু যদি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষার মান বাড়াতে পারতাম আমাদের কি ধারণা আছে কি পরিমাণ ডলারের সাশ্রয় হতো? শুধু তাই না ব্রেইন ড্রেইনও কমতো। ঐদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে কম খরচ করে আমার সোনার বাংলা বাংলাদেশ। শিক্ষা খাতে জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ আর স্বাস্থ্য খাতে তা ১ শতাংশেরও কম। করবে না কেন?
এসব বরাদ্দের দায়িত্বে যারা তারা বা তাদের সন্তানরা কি এই দেশের পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে বা এই দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়? এখানেই সকল সমস্যার ভূত লুকিয়ে আছে। যতোদিন না আমরা দেশের এমপি, মন্ত্রী আমলা ও তাদের সন্তানদের এই দেশের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে ও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করবো ততোদিন এই দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না। তারা পাদে গন্ধ হলেই সিঙ্গাপুর, ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় দৌঁড়ায়। তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে ইউরোপ, কানাডা কিংবা আমেরিকায়। তারা কেন এই দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের কেয়ার করবে? কেন?
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।