সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জে বিচারকের জাল স্বাক্ষর ও আইনজীবীদের জাল সীলসহ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে পেমেন্ট অর্ডারের সরকারী কোষাগারের শতাধিক বিচার প্রার্থীর প্রায় ৩৩ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ ওঠেছে। এই ঘটনায় ছয় আইনজীবীসহ ২১ জনের নাম উল্লেখ্যসহ কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। তবে মূলহোতা ওই অফিসেরই হিসাব সহকারী ইমরান নাজির জালিয়াতি ফাঁসের পরই দুবাই পাড়ি জমিয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলাটি করেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সুজন শিকদার। সরকারের কোষাগার তছরুপের অভিযোগে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হিসাব সহকারী ইমরান নাজিরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেন, জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বরখাস্তকৃত হিসাব সহকারী ইমরান নাজির, জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার নজরুল ইসলাম ও হিসাবরক্ষণ সুপার দেওয়ান ফেরদৌস ওয়াহিদ, ইমরান নাজিরের ভগ্নিপতি আবুল হোসেন, ইমরান নাজিরের গাড়ী চালক মোহাম্মদ জামাল, মো.হাফিজুর রহমান, মো.রুস্তম আলী, ইমরান নাজিরের সমন্ধী মো. রুবেল হোসেন, মো.ফরিদ রায়হান, আইনজীবী আফরিন আক্তার মীম, ইমরান নাজিরের বন্ধু মো. শরীফুল ইসলাম, ইমরান নাজিরের ফুপা ঢাকার আইনজীবী মো.মুনসুর আলম, কানন আক্তার, আইনজীবী হুমায়ন কবীর, আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিটুল, আইনজীবী নিলুফা আক্তার, আইনজীবী রেহেনা খানম, আইনজীবী জেসমিন রহমান বিথী, শিক্ষানবিশ আইনজীবী আতিকুর রহমান, ইমরান নাজিরের চাচাতো ভাই মো.হাবিবুর রহমান ও মো.ফজলুল হক। এছাড়াও বেশ কয়েকজনকে অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামি করা হয়েছে।
মামলার অন্যতম আসামি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত হিসাব সহকারী ইমরান নাজির কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ধোকারাকোল এলাকার মৃত নাজমুস সাহাদতের ছেলে। তিনি ২০১৮ সালে মানিকগঞ্জ জজ আদালতের মাধ্যমে চাকুরি শুরু করেন।
এজাহারপত্র সূত্রে জানা যায়, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে ২০১৯ সালের ৮ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ২২ আগষ্ট পর্যন্ত কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সার্বিক সহযোগিতায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হিসাব শাখার ভারপ্রাপ্ত বিচারক কামরুন নাহারের স্বাক্ষর জাল ও আইনজীবীদের জাল সীল ও প্রিয়েমশনসহ আদালতে চলমান ও নিষ্পত্তিকৃত বিভিন্ন মামলার ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার ও চালান তৈরি করা হয়। ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার ও চালানের মাধ্যমে অভিযুক্তরা তাদের ও তাদের আত্মীয়দের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারে জমাকৃত শতাধিক বিচার প্রার্থীর ৩২ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার ৭৬৭ টাকা আত্মসাৎ করেন।
এরমধ্যে আবুল হোসেন দুই কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৮০ টাকা, ইমরান নাজিরের গাড়ি চালক এক কোটি ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার ৮৪১ হাজার টাকা, মো. হাফিজুর রহমান ৬৮ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকা, মো. রুস্তুম আলী এক কোটি ৬১ লাখ ২৭ হাজার ৮৯ টাকা, মো. রুবেল হোসেন এক কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ৫১ টাকা, মো.ফরিদ রায়হান ৩১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, আইনজীবী আফরিন আক্তার মীম ৫১ লাখ ৯ হাজার ৪৪৩ টাকা, মো.শরীফুল ইসলাম তিন কোটি ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ টাকা, মো.মুনসুর আলম ৩০ লাখ ৫১ হাজার ৭৯০ টাকা, কানন আক্তার ৯৮ লাখ ২১ হাজার ৮০০ টাকা, আইনজীবী হুমায়ন কবীর তিন কোটি ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮৩ টাকা, আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিটুল এক কোটি ৭৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৭০ টাকা, আইনজীবী নিলুফা আক্তার এক কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার ৬০৪ টাকা, আইনজীবী রেহেনা খানম এক কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার ৬০৪ টাকা, আইনজীবী জেসমিন রহমান বিথী ৪৮ লাখ ৯১ হাজার ১১০ টাকা, শিক্ষানবিশ আইনজীবী আতিকুর এক কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার ৮৫৭ টাকা ও মো.ফজলুল হক ২১ লাখ টাকা স্ব স্ব নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে উতোতলন করেছেন।
এজহারপত্রে আরো উল্লেখ্য করা হয়েছে, আদালতের হিসাব শাখার ভারপ্রাপ্ত বিচারক কামরুন নাহারের স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ায় চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর ইমরান নাজিরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হলে ইমরান নাজির বিচারকের স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করেন। কিন্তু তার ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় ৯ সেপ্টেম্বর ইমরান নাজিরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারককে লিখিতভাবে অনুরোধ করা হয়। পরে ইমরান নাজিরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার করা হয় এবং তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এরপর প্রাথমিক তদন্তে বিচারকের জাল স্বাক্ষর ও আইনজীবীদের জাল সীলসহ ভুয়া কাগজপত্রের তৈরি করে পেমেন্টে অর্ডারের সরকারী কোষাগারের অর্থ আত্মসাতে জড়িত থাকায় আইনজীবীসহ ২১জনের নাম উল্লেখ্যসহ কয়েকজনকে অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামী করে দুর্নীতি দমন কমিশনের আদালতের পক্ষে মামলা করেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সুজন শিকদার।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আইনজীবী আ.ফ.ম নূরতাজ আলম বাহার বলেন, সরকারী কোষাগারের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখ্যজনক। সরকারী কোষাগারের টাকা আত্মসাতের কথা শুনলে সাধারণ মানুষকে কি ভাববে। তাছাড়া যারা প্রিয়মশন মামলা করে তাদের টাকাসহ বিভিন্ন টাকা সরকারী কোষাগারে জমা থাকে। মামলা নিষ্পত্তির পর অথবা রায়ের পর সে টাকা তারা তুলে নেন এবং ভুক্তভোগীকে ফেরত দেওয়া হয়। সুতরাং বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। কারণ তাদের সাথে আরো অনেকে জড়িত থাকতে পারে।
মামলার বাদী মো.সুজন শিকদার বলেন, পূর্বে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার ও চলমান কিছু মামলার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তাছাড়া চলমান মামলায় টাকা জমা আছে পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু চলমান মামলায় ইমরান নাজির দেখিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা। ভারপ্রাপ্ত বিচারক মহোদয়ের স্বাক্ষর জালসহ মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির কিছু আইনজীবীর সীলও জাল আছে। এসব দেখে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ হয়। পরে প্রাথমিক তদন্তে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ইমরান নাজির ও আইনজীবীসহ ২১জনের নাম উল্লেখ্য করে এবং কয়েকজনকে অজ্ঞাত করে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা করেছি। এসব অপকর্মের সাথে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসারসহ কিছু অফিসার জড়িত এবং তাদের ম্যানেজ করেই সরকারী কোষাগারের টাকা আত্মসাৎ করেছে বলেও তিনি জানা।
এদিকে মামলার অন্যতম আসামি ইমরান নাজির বরখাস্তকৃত হওয়ার পর গোপনে দুবাই পালিয়ে গেছে। একারণে তার মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে ইমরান নাজিরের স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার স্বামী দুবাই গেছে। যাওযার আগে আমার ভাইয়ের অ্যাকাউন্টের সব টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। অবৈধ টাকার বিষয়ে স্বামী ইমরানের কাছে জানতে চাইলে, গাড়ীর ব্যবসা ও জমিজমার কথা বলতেন বলেও জানান ইমরান নাজির স্ত্রী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।