জুমবাংলা ডেস্ক : ২০২২ সালে দেশে মোট ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুল ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৪০ জন। কলেজ ও সমমান পর্যায়ে ১০৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৩২০ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ২১২ জন। আত্মহত্যার শীর্ষে রয়েছে নারী শিক্ষার্থী। এর মধ্যে গড়ে প্রতি মাসে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
গতকাল শুক্রবার ‘স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা : সমাধান কোন পথে?’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আঁচল ফাউন্ডেশন। ওই সমীক্ষায় এসব তথ্য জানানো হয়। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের দেড় শতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
সমীক্ষার তথ্যে দেখা গেছে, এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে নারী ৬৫.৯৩ শতাংশ ও পুরুষ ৩৪.০৭ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় বলে এ বয়সে আত্মহত্যাপ্রবণতা বেশি।
শীর্ষে ঢাকা : দেশের মোট আটটি বিভাগে আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বাধিক ঢাকা বিভাগে, ২৩.৭৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ৪.৪৮ শতাংশ।
প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা : সমীক্ষা প্রতিবেদনের মাসভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত বছর গড়ে প্রতি মাসে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৪০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৭ জন, মার্চে ৪৮ জন, এপ্রিলে ৫৩ জন, মে মাসে ৬২ জন, জুনে ৩৬ জন, জুলাইয়ে ৪৯ জন, আগস্টে ২৩ জন, সেপ্টেম্বরে ৪০ জন, অক্টোবরে ৩৮ জন, নভেম্বরে ৫৬ জন এবং ডিসেম্বরে ৪০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যার পেছনে কারণ : মান-অভিমান শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে। ২৭.৩৬ শতাংশ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে অভিমান করে। তাদের বড় একটি অংশ অভিমান করেছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রেমঘটিত ২৩.৩২ শতাংশ, পারিবারিক কলহ ৩.১৪ শতাংশ, হতাশাগ্রস্ততা ২.০১ শতাংশ, মানসিক সমস্যা ১.৭৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যা ১.৭৯ শতাংশ, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৩.১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
আত্মহত্যাপ্রবণতা কমাতে আঁচলের ১১ প্রস্তাব : শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাপ্রবণতা কমাতে আঁচল ফাউন্ডেশন ১১টি প্রস্তাবনা দিয়েছে। প্রস্তাবনাগুলো হলো—
১. হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা।
২. সন্তানদের মানসিক বিকাশ এবং তাদের সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করা।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৪. স্কুল, কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন করা।
৫. প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে আইনি বাধ্যবাধকতায় অন্তর্ভুক্ত করা।
৬. স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্ব্বিত করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান কাজে লাগানো। এতে আর্থিক সংকটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে।
৭. প্রেম-প্রণয়ঘটিত সম্পর্কে বা অজ্ঞাতসারে ধারণ করা গোপন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ ও সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে শাস্তি উল্লেখপূর্বক বিশেষ প্রচারণাভিযান পরিচালনা করা।
৮. স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা। এর মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে।
৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার খোলা। শিক্ষার্থীদের বৃত্তির আওতায় এনে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ট্রেনিং দেওয়া।
১০. কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।
১১. শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানো।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের শিক্ষক এবং মা-বাবার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুকালে বাচ্চাদের ওপর মা-বাবার প্রভাব যেমন বেশি থাকে, কৈশোরে সেই দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষকদের ওপর। তাই শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনে তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বেশি। আমাদের দেশে সন্তান লালন-পালনের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে শেখার সুযোগ নেই বললেই চলে। আবার সন্তান লালন-পালনও যে শিক্ষণীয় একটি বিষয় তাও মানতে নারাজ অনেক মা-বাবা। ফলে সন্তানদের মানসিক বিষয়গুলো নিয়ে মা-বাবারা অনেক ক্ষেত্রে উদাসীন থাকেন। তাই সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি তত গুরুত্ব দিতে চান না। স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে শিক্ষকরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো শুনে মেন্টরের ভূমিকা পালন করতে পারেন।’
মনোচিকিৎসক শাহরিনা ফেরদৌস বলেন, ‘২০২২ সালের এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বেশি। কী কারণে তাদের সংখ্যা গত বছর এত বেশি ছিল, তার কারণগুলো অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিশেষ করে তাদের পারিবারিক বন্ধন, ব্যক্তিগত চাহিদা, সামাজিক অবস্থান এসব বিষয় জানার প্রয়োজন রয়েছে।’
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আঁচল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার সিয়াম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে পরিবারিক, সামাজিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো রপ্ত করতে শেখাতে হবে। নিজের আচরণ এবং অন্যের প্রতি সমব্যথী হয়ে কিভাবে নেতিবাচক মন্তব্য বা পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে হয়, তার চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।