জুমবাংলা ডেস্ক : ঢাকা শহরে গত ছয়মাসে ৬৩.৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী গণপরিবহনে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৬.৫ নারীকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। হয়রানকারীদের ৬১ শতাংশই মধ্যবয়স্ক পুরুষ।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আঁচল’ পরিচালিত এক জরিপে এ সব তথ্য উঠে আসে। ঢাকা শহরের গণপরিবহনে নারীরা কোন ধরনের হয়রানির শিকার হয় এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব পর্যালোচনায় জরিপটি পরিচালনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন।
জরিপে ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮০৫ জন নারী অংশগ্রহণ করেন। এতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, যা ৮৬.০৯ শতাংশ।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৩৩.২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, তারা দিনে অন্তত ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা গণপরিবহনে ব্যয় করেন। ৩২.৫ শতাংশ অন্তত ১ থেকে ২ ঘণ্টা সময় গণপরিবহনে অতিবাহিত করেন। ২৪.৭ শতাংশ ১ ঘণ্টার কম এবং ৫.৮ শতাংশ ৪ ঘণ্টার বেশি সময় গণপরিবহনে ব্যয় করেন।
সমীক্ষায় জানা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র বা বিবিধ কাজে যাতায়াতের প্রয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬৯.৪৪ শতাংশ গণপরিবহনে এবং ৬.৫৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব যানবাহনে আসা যাওয়া করেন। এ ছাড়াও ২.৭৩ শতাংশ চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করে থাকেন।
গণপরিবহনে চলাচলকারীদের ৮৪.১০ শতাংশ বাসে চলাফেরা করেন, ৪.৫৮ শতাংশ ট্রেন বা রেলে যাতায়াত করেন, রাইড শেয়ারিংয়ে যাতায়াত করেন ১.৫৩ শতাংশ এবং সিএনজি ব্যবহার করেন ৩.২৭ শতাংশ। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যবহৃত যানবাহন বাস। গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮৪.১০ শতাংশ নারী বাস ব্যবহার করেন।
এদিকে আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত জরিপের উপাত্ত অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গত ছয় মাসে ৬৩.৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী গণপরিবহনে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৬.৫ শতাংশ বলেছেন তাদেরকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ১৫.৩ শতাংশ বুলিং, ১৫.২ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৪.৯ শতাংশ লিঙ্গ বৈষম্য এবং ৮.২ শতাংশ বডি শেমিং-এর মতো হয়রানির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। জরিপে গণপরিবহনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া।
এদের মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের ৭৫ শতাংশ নারী অন্যযাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ২০.৪ শতাংশের ক্ষেত্রে হেল্পার কর্তৃক এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এছাড়াও ৩ শতাংশ হকারের মাধ্যমে এবং ১.৬ শতাংশ ড্রাইভারের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, গণপরিবহনকে অনিরাপদ করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক সাধারণ যাত্রীরা। সমীক্ষা বলছে, এসব হয়রানির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আছেন চল্লিশ থেকে ঊনষাট বছর বয়সী মধ্যবয়সী পুরুষ।
সমীক্ষায় ‘কারা বেশি যৌন হয়রানি করছে’—এমন প্রশ্নের উত্তরে ৬১.৭ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, তারা চল্লিশ থেকে ঊনষাট বছর বয়সীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে, ৩৬.৩ শতাংশ জানিয়েছেন যে, তারা কিশোর ও যুবক অর্থাৎ তেরো থেকে ঊনচল্লিশ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এদিকে, গণপরিবহনের হয়রানি প্রভাব ফেলছে মানসিক স্বাস্থ্যেও। সমীক্ষায় দেখা যায়—২১.২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী গণপরিবহন ব্যবহারের সময় যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে পরবর্তীতে ট্রমাটাইজড হয়েছেন। ২৯.৪ শতাংশের মনে গণপরিবহন এক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৬.৪ শতাংশ হীনমন্যতায় এবং ১৩.৮ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগেছেন বলে জানিয়েছেন।
সমীক্ষায় আরও জানা যায়—গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হওয়ার পর সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ জানিয়েছেন ঐ পরিবহণের কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। মাত্র ৪৩ শতাংশ জানিয়েছেন যে অন্যদের সাহায্য পেয়েছেন। গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হলে সাহায্য পাওয়ার জন্য ৯৯৯ এ কল করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। ৬২.৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী হেল্পলাইন সম্পর্কে জানলেও সহায়তা নিয়েছেন মাত্র ২.৫ শতাংশ।
এদিকে যৌন হয়রানির পর গণপরিবহনের অন্যান্য যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া এবং আচরণ সেই পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ ভূমিকা রাখলেও যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর ৩৬.৯ শতাংশ বলেছেন অন্যযাত্রীরা যৌন হয়রানির মতো ঘটনাকে উপেক্ষা করে গেছেন। এমনকি ২ শতাংশ তরুণী ও কিশোরী জানিয়েছেন গণপরিবহনের অন্যযাত্রীরা নিপীড়নকারীকে সমর্থনও করেছেন।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৯৭.৬ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী মনে করেন কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজধানী ঢাকা শহরের প্রতিটি সড়কে নারীদের জন্যে সংরক্ষিত বাস বাড়ানো উচিত এবং ৯৪ শতাংশ মনে করেন নারীদের সংরক্ষিত সিট সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন।
গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানি নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. ইসমাইল হোসাইন বলেন, ‘আঁচল ফাউন্ডেশন এর এই জরিপের মধ্যে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এই সামাজিক সমস্যাকে পুরোপুরি মোকাবিলা করতে হলে আমদের নৈতিকতাকে ঠিক করতে হবে, আমাদেরকে সামাজিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং আইনের সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আজকের এই সমীক্ষার ফলাফল নারীদের প্রতি আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে এই সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে আমাদের মনোজাগতিক পরিবর্তন আনয়ন জরুরি। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া নারীর সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়’
নারীদের প্রতি হয়রানি, সহিংসতা দিন দিন বাড়ছেই। সেটা বাসায় হোক, রাস্তাঘাটে কিংবা গণপরিবহনে—এমনটাই মনে করছেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ। তিনি বলেন, ‘একুশ শতাব্দীতে কিশোরী ও তরুণীরা যখন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে তখন যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানি তাদের অবদানকে বাধাগ্রস্ত করবে।’
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এই সকল হয়রানির প্রভাব নিয়ে তানসেন বলেন ‘আমরা দেখেছি গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হলে তরুণীদের কাজের স্পৃহা কমে যায়, তাদের বিষণ্ণতা বেড়ে যায়। এই বিষণ্ণতা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকেও ধাবিত করতে পারে।’
এদিকে, গণপরিবহন নিরাপদ করতে আঁচল ফাউন্ডেশন কয়েকটি প্রস্তাব রেখেছে। গণপরিবহনে সিট সংখ্যার বেশি যেন যাত্রী না তোলার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া, সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে বাস স্টাফসহ যাত্রীদের পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা, প্রতিটি বাসে সিটের পাশে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক বিভিন্ন লিফলেট লাগানো, সময় ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাসে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা জরুরিভিত্তিতে বাড়ানো, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা, বাসের হেল্পার, সুপারভাইজার ও চালকদের পরিচয় উল্লেখপূর্বক নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা, বাসে নিপীড়নের ঘটনায় সেই বাসের স্টাফদের দায়ভার নেওয়ার বিধান প্রণয়ন করা, নিপীড়িত নারীর প্রতিবাদে কেউ আক্রমণাত্মক হলে তাকে শক্তভাবে প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেওয়া, গণপরিবহনে যৌন হয়রানির ঘটনায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা; প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিচার নিশ্চিত করা, এবং বাসের হেলপার সুপারভাইজার ও চালকদের জন্য বিশেষ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন বিরোধী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করে সংগঠনটি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।