জুমবাংলা ডেস্ক : মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ জেলার মধ্যবর্তী স্থান শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৪টি বিভাগে ৮জন শিক্ষক ও ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় একাডেমিক কার্যক্রম। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে শুক্রবার (২২ নভেম্বর) প্রতিষ্ঠার ৪৬ বছরে পদার্পণ করছে ১৭৫ একরের এই বিদ্যাপীঠ। শিক্ষা-গবেষণায়, সংস্কৃতি-ক্রীড়াঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অর্জন দীর্ঘ পথচলাকে গৌরবান্বিত করেছে। দীর্ঘ পথচলায় বিদ্যাপীঠটি উচ্চশিক্ষার দীপ্ত মশাল ছড়িয়ে দিয়েছে দেশের সব প্রান্তে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৭৬ সালে ১ ডিসেম্বর দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসারে তৎকালীন সরকার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। পরে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এছাড়া ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৮০ (৩৭) পাস হয়। এরপর ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন দুটি অনুষদের চারটি বিভাগে ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি অনুষদের অধীন রয়েছে ৩৬টি বিভাগ। রয়েছে ৪০৬ জন শিক্ষক ও ১৫ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী এবং ৭৩৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়াও বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ জন। এখানে রয়েছে সুবিশাল স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, মুক্ত বাংলা, চিকিৎসা কেন্দ্র, ব্যায়ামাগার ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। রয়েছে ক্যাম্পাস ভিত্তিক সর্ববৃহৎ মসজিদ ও দৃষ্টিনন্দন মফিজ লেক।
শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন খেলার জন্য রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে বই রয়েছে প্রায় এক লক্ষ ২৬ হাজার। এছাড়াও জার্নাল, ম্যাগাজিন এবং নিউজ পেপার এর সংখ্যা ১৯ হাজার চারশত (প্রায়)। রিমোট এক্সেস এর মাধ্যমে অনলাইনে সাবস্ক্রাইবড ই-বুক এবং ই-জার্নাল পড়ার সুবিধা রয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিনিময়ের লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সম্প্রতি চীনের সাউথইস্ট ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যেখানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ এবং চীনের সাউথইস্ট ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ড. ওয়াং ওয়াইবিন স্বাক্ষর করেন। এছাড়াও গত ২৪ অক্টোবর বিআইআইটি অডিটোরিয়ামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক থট (আইআইআইটি)-এর সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি এ পর্যন্ত ৬২৪ জনকে পিএইচ.ডি এবং ৭৮৮ জনকে এম.ফিল ডিগ্রি প্রদান করেছে। বর্তমানে ১৬৪ জন পিএইচ.ডি এবং ৪৭ জন এম.ফিল গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন।
শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি ক্রীড়াক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিকস ও ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এ্যাথলেটিক্স-এ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাত বার এবং ছাত্রীরা আট বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ফুটবলে তিন বার, হ্যান্ডবলে (ছাত্র) তিন বার, ভলিবল (ছাত্র)-এ ১৩ বার এবং বাস্কেটবলে চার বার চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও ব্যাডমিন্টনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২০২৪ সালে এবং ছাত্রীরা ২০১৭ ও ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি অর্জন করে। এ বিশ্বব্দ্যিালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্রী তামান্না আক্তার সাত বার জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার হাডেলস ইভেন্টে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
এ ছাড়া শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলে গাড়ি রয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে ৫২ আসনের নন এসি বাস ১৩টি, দ্বিতল বাস ১টি, এসি বাস ১টি, ৩০ আসনের এসি কোস্টার ৭টি, নন-এসি মিনিবাস ৫টি, হায়েস এসি মাইক্রো ৫টি, জীপ ৭টি, কার ৩টি, পিক-আপ ২টি এবং অ্যাম্বুলেন্স ২টি। এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ভাড়াকৃত ৯টি দ্বিতল বাসসহ মোট ৩২টি বাস-মিনিবাস রয়েছে।
এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম সমাবর্তন ২৭ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে, দ্বিতীয় সমাবর্তন ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে, তৃতীয় সমাবর্তন ২৮ মার্চ ২০০২ সালে এবং সর্বশেষ ৪র্থ সমাবর্তন ৭ জানুয়ারি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
এ ছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৩৭ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের ৩২টি অঙ্গের মধ্যে ১৩টি অঙ্গের কাজ সমাপ্ত হয়েছে এবং চারটি অঙ্গের কাজ ডিসেম্বর/২০২৪ এর মধ্যে শেষ হবে। বাকি ১৫টি অঙ্গের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নয়টি দশ তলা ভবনের সবগুলোর নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। ১১টি ভবনের উর্দ্ধমুখী সম্প্রপসারণের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শ্রেণিকক্ষ ও আবাসন সংকটের অনেকটাই নিরসন হবে। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ও সোলার প্যানেল এবং বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ২টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে। এছাড়াও এ প্রকল্পের আওতায় ১টি উন্মুক্ত জলাশয় তৈরির কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে নানা অর্জনের পাশাপাশি বেশকিছু সংকটও রয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণা, চিকিৎসা ও আইটি খাতে অপর্যাপ্ত বাজেট, শ্রেণীকক্ষ সংকট, কিছু বিভাগে সেশনজট, আবাসন সমস্যা, পরিবহন সংকট, প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পুরোপুরি অটোমেশনের আওতায় না আসা, মানসম্মত খাবার ও সুপেয় পানির অভাবসহ নানা সমস্যায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে আটটি আবাসিক হল রয়েছে। তবে তা শিক্ষার্থী তুলনায় যথেষ্ট না। ফলে প্রায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করতে হয়। মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আবাসন ও শ্রেণিকক্ষ সংকট কমে আসবে বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ নিয়োগ পান। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে ধারাবাহিক মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছেন তিনি। মতবিনিময়কালে বিভাগসমূহে বিরাজমান সংকটগুলো তিনি গুরুত্ব সহকারে জানার চেষ্টা করেছেন এবং সেগুলো ক্রমান্বয়ে নিরসনের চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রদানের মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।