জুমবাংলা ডেস্ক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান তাসিব। পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ম্যানেজম্যান্ট স্ট্যাডিজ বিভাগে। মানুষ যেখানে স্বভাবতই সাপ দেখলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়, লাঠি-সোটা নিয়ে মারতে উদ্যত হয়, এমনকি বাস্তুতন্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এ প্রাণীটিকে দেখামাত্র মেরে ফেলে। সেখানে তাসিব নিজেই বাঁচিয়েছেন ১৯টি বিষধরসহ ৪৭টি সাপের প্রাণ।
পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে সাপের দা-কুমড়া সম্পর্কটাকে ঠিক করতে দীর্ঘ ৩ বছর যাবত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনে কিংবা হলে, দোকানপাটে কিংবা রাস্তাঘাটে যেখানেই সাপের দেখা মিলে সেখানেই ডাক পড়ে তাসিবের। আর সব কাজের ব্যস্ততা ফেলে ডাক পাওয়ামাত্রই ছুটে আসেন তিনি। সাপ যত্নসহকারে উদ্ধারের পাশাপাশি উপস্থিত সবাইকে সাপ সম্পর্কে সম্যক ধারণাও দেন তাসিব। ফলে ক্যাম্পাসে সাপ দেখলেই মেরে ফেলার প্রবণতাও কমে গেছে।
সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হল থেকে উদ্ধার করেছেন খৈয়া গোখরার মতো বিষধর সাপ। নিজে এবং নিজের উদ্ধারকাজের টিমের দ্বারা ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে এ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে অন্তত ৪৭টি সাপ উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে অবমুক্ত করেছেন তিনি।
সাপ উদ্ধার করার মতো বিপজ্জনক কাজকে সাদরে আলিঙ্গন করার বিষয়ে কথা হয় মিজানুর রহমান তাসিবের সঙ্গে।
শুরুর গল্পে তাসিব বলেন, ছোটবেলা থেকেই যেকোনো পশু-পাখির প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা ছিল তার। রাবিতে ভর্তি হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রুপে তিনি দেখেন ক্যাম্পাসে বাচ্চাসহ একটি সাপকে মারার পোস্ট দিয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের সচেতন করছেন কিছু শিক্ষার্থী। বিষয়টি দেখে মর্মাহত হন তিনি।
এরপরই বাংলাদেশের সব সাপ সম্পর্কে জ্ঞান আরোহণ করতে শুরু করেন এবং ‘ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠনে যুক্ত হন তিনি। তারপর থেকে সাপ সম্পর্কে সব ধরনের ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে বোঝাতে শুরু করেন তিনি। তবে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে ব্যর্থ হওয়ায় নিজেই সাপ উদ্ধার কাজ শুরু করেন বলে জানান এই শিক্ষার্থী।
তাসিব জানান, তার সাপ উদ্ধার কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১ অক্টোবরে। প্রথমদিকে নির্বিষ সাপগুলো উদ্ধার করতেন তিনি। এরপর ২০২১ সালের জুন মাসে ‘ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে বিষধর গোখরা সাপ উদ্ধার করার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পান এই শিক্ষার্থী। তারপর ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাসের বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে জলঢোড়া, চিত্রিত ঢোড়া, বেত আছড়া, দাঁড়াশ, ঘরগিন্নি, মেটে এবং হেলে সাপের পাশাপাশি খৈয়া গোখরা এবং কালাচ বা পাতি কাল কেউটের মতো বিষধর সাপও উদ্ধার করেন তিনি।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে করোনার পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলে অক্টোবরের ১৪ তারিখে রাবির প্রত্যেকটি হলে সাপ না মেরে উদ্ধারের জন্য ফোন করার আহবান জানিয়ে একটি করে পোস্টার টানাই। পাশাপাশি হলের গার্ডদেরও সচেতন করি। আর এ কার্যক্রমের ব্যাপারে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ ফেসবুক গ্রুপেও সবাইকে জানাই। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম খালেদা জিয়া হল, মাদার বখ্শ হল, তাপসী রাবেয়া হল, জোহা হল, শহীদ হবিবুর রহমান হল, শেরে বাংলা হল, পূর্বপাড়া স্টাফ কোয়ার্টার, চারুকলা এবং পরিবহণ মার্কেট থেকে প্রায় ২০টির মতো সাপ উদ্ধার করি। যার মধ্যে মারাত্মক বিষধর খৈয়া গোখরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলে উদ্ধারকৃত এশিয়ার অন্যতম বিষধর সাপ কালাচ বা পাতি কাল কেউটেও ছিল।
নিজে সাপ উদ্ধারের পাশাপাশি অন্যদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন তাসিব। তিনি বলেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রাবির বিভিন্ন শিক্ষার্থী যারা সাপসহ প্রকৃতি নিয়ে ভাবে, কাজ করতে ইচ্ছুক তাদের ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের সাধারণ মেম্বার হিসেবে যুক্ত করি। প্রায় ২০ জন যুক্ত হয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে সাপ সংক্রান্ত বিস্তারিত ধারণা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে নিতে থাকে। তাদের ক্লাস শেষ। পরীক্ষাও নেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুতই তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। বর্তমানে তারা আমার সাথে সাপ উদ্ধার কাজে যাচ্ছে, সামনে থেকে সব শিখছে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন রাসেল পূর্ণাঙ্গভাবে রেসকিউর কাজ শিখে নিয়েছে।
তাসিব জানান, রাবিতে সচরাচর যেসব সাপ দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভেমটা, মেটে, জলঢোড়া, দাঁড়াশ, বেত আছড়া, ঘরগিন্নি। এছাড়া বিষধর খৈয়া গোখরা এবং কালাচ বা পাতি কাল কেউটে সাপেরও দেখা মিলে।
সাপকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে এবং একটি সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকল্পিতভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার দাবি জানিয়ে তাসিব বলেন, আমরা ক্যাম্পাসে সাপ উদ্ধারের পাশাপাশি অন্যান্য পশুপাখিও উদ্ধার কাজ করছি এবং বৃক্ষরোপণও করছি। উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ আমাদের নেই এবং শিক্ষার্থী হওয়ায় নিজে নিজে সবকিছু ক্রয় করার সামর্থ্যও কম আমাদের। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা করলে আমরা আরও ভালো কাজ করতে পারব।
তাসিবের এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, তাসিব স্বপ্রণোদিতভাবে যে কাজটি করছে এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। এটা আমাদের নজরে এসেছে। সে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এবং তার চাহিদার বিষয়গুলো জানালে আমরা তাকে সাহায্য করব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।