মুফতি আবদুল্লাহ তামিম : মাহে রমজানে হাজার মাস থেকে উত্তম এক রাত রয়েছে। যে রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। এ রাতে ইবাদতের সৌভাগ্য লাভ হলে আল্লাহ তাআলা অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেন। আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও বিশ্বাসের সাথে, সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে, শবে কদরের রাত্রে দাঁড়ায়, তার আগেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারি)।
এ রাতটি রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে খুঁজতে বলা হয়েছে হাদিসে। হযরত আয়েশা রা. বলেন, নবীজি বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের সন্ধান কর। (বুখারি ২০১৭, মুসলিম ১১৬৯) এ রাতে বিশেষ কিছু আমল করা জরুরি।
ইশা ও ফজর নামাজ জামাতে আদায় করা
কদরের রাতের ফজিলত ও বরকত লাভের জন্য অনেকে রাতভর নফল নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেকে যে ভুলটি করেন তাহলো জামাতে নামাজে গুরুত্ব দেন না। অথচ নফল ইবাদতের থেকেও ফরজের গুরুত্ব বেশি।
শবে কদরে অন্তত ইশা ফজরের নামাজ জামাতে আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। কোনোভাবে যেন জামাতের নামাজ ছুটে না যায় এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়ে, সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে। (মুসলিম ৬৫৬)
রাত জেগে ইবাদত করা
লাইলতুল কদরে রাত জেগে ইবাদতের অনেক অনেক ফজিলত রয়েছে। নবীজি বলেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করবে, অতঃপর সে রাত লাভ করার তাওফিকপ্রাপ্ত হবে, তার পিছনের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে। (মুসনাদ আহমাদ ২২৭১৩)
শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহানবী সা. আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবে কদরে ইবাদত করবে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম: ৭৬০; বুখারি: ২০১৪)
ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকা
কদরের রাতটিকে হাদিসে নির্দিষ্ট করা হয়নি। এ রাতটি সম্পর্কে আল্লাহর রসুল সা. সাহাবিদের জানাতে গিয়েছিলেন, কিন্তু দুই ব্যক্তির ঝগড়ার কারণে তা গোপন রাখা হয়। এ বিষয়ে হযরত উবাদা ইবনে সামিত রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে জানাতে বের হলেন। এ সময় দু্ইজন মুসলমান ঝগড়া করছিলেন।
তখন নবী কারিম সা. বললেন, ‘আমি আপনাদের ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে অবহিত করতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হওয়ায় তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, উঠিয়ে নেওয়াটা আপনাদের জন্য বেশি ভালো হয়েছে। আপনারা সপ্তম (২৭ তম), নবম (২৯ তম) এবং পঞ্চম (২৫ তম) তারিখে এর সন্ধান করুন।ব (বুখারি ৪৯)
রমজানের শেষ দশকের পুরোটা সময় বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকা উচিত। বলা যায় না, কোনো একটি রাত হয়তো কদরের হলো কিন্তু কেউ বিবাদে লিপ্ত থাকার কারণে তা থেকে বঞ্চিত হলেন।
সালাতুস তাসবিহের নামাজ আদায় করা
এ রাতে সালাতুস তাসবিহ আদায়ের অনেক অনেক ফজিলত রয়েছে। সালাতুত তাসবিহ। তাসবিহের নামাজ। সালাত শব্দের অর্থ নামাজ। আর তাসবিহ বলতে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ শব্দগুলো বোঝানো হয়েছে। যে নামাজে এসব তাসবিহ পড়তে হয়, তাকে সালাতুত তাসবিহ বলে।
নবী কারিম সা. জীবনে একবার হলেও মুসলমানরা যেন এ নামাজ পড়ে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস ১২৯৭, ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৩৮৭, সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস ১২১৬, সুনানে বায়হাকি কুবরা, হাদিস ৪৬৯৫)
রাসুলুল্লাহ সা. তার চাচা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে এই নামাজ শিক্ষা দিয়েছিলেন। বলেছেন, এই নামাজ পড়লে আল্লাহ তাআলা আগের ও পরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।
তিনি বলেন, চাচা! আপনি যদি পারেন, তবে দৈনিক একবার করে এই নামাজ পড়বেন। যদি দৈনিক না পারেন, তবে সপ্তাহে একবার পড়বেন। যদি সপ্তাহে না পারেন, তবে মাসে একবার পড়বেন। যদি মাসে না পারেন, তবে বছরে একবার পড়বেন। যদি এটাও না পারেন, তবে সারা জীবনে একবার হলেও এই নামাজ পড়বেন । (বুখারি ৩৪২৩, ইবনে মাজা ১৭৩)।
সালাতুল তাসবিহ নামাজ চার রকাত। নিয়ত স্বাভাবিকভাবে করলেই হবে। ‘আমি চার রাকাত নফল নামাজ সালাতুস তাসবিহ পড়ছি’। প্রতি রকাতে সুরা ফাতিহার পর যে কোনো সুরা পড়তে হবে। তবে এই নামাজে প্রতি রাকাতে ৭৫ বার করে, চার রকাতে ৩০০ বার তাসবিহ পড়তে হয়।
سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ للهِ، وَلَا إلَهَ إلّا اللهُ، وَاللهُ أكْبَر উচ্চারণ: সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।’ অর্থ: মহা পবিত্র আল্লাহ। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ সবার চেয়ে বড়।
প্রথম রাকাত এ সানা পড়ার পর তাসবিহ ১৫ বার পড়তে হবে। তারপর স্বাভাবিক নিয়মে সুরা ফাতিহা ও অন্য আরেকটি সুরা পড়ার পর তাসবিহ ১০ বার পড়তে হবে। রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবিহ পড়ার পর তাসবিহ ১০ বার পড়তে হবে। রুকু থেকে দাঁড়িয়ে ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ পড়ার পর তাসবিহ ১০ বার পড়তে হবে। সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবিহ পড়ার পর তাসবিহ ১০ বার পড়তে হবে।
প্রথম সিজদা থেকে বসে তাসবিহ ১০ বার পড়তে হবে। আবার সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবিহর পর তাসবিহ ১০ বার পড়তে হবে। এভাবে প্রতি রাকাতে মোট ৭৫ বার এ তাসবিহ পাঠ করতে হবে। একইভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাত পড়তে হবে। (তিরমিজি হাদিস ৪৮১, আবু দাউদ হাদিস ১২৯৭, ইবনু মাজাহ হাদিস ১৩৮৬, ১৩৮৭, মুসতাদরাক হাকিম ১/৪৬৩-৪৬৪, ইবনু খুযাইমা ২/২৩-২৪, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৮১-২৮৩, তারগিব ১/৩৫৩-৩৫৫)
তবে কোনো এক স্থানে তাসবিহ পড়তে সম্পূর্ণ ভুলে গেলে বা ভুলে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে কম পড়লে পরবর্তী যে রুকনেই স্মরণ আসুক সেখানে সংখ্যার সঙ্গে এই ভুলে যাওয়া সংখ্যাগুলোও আদায় করে নেবে।
গুনাহ মাফের দোয়া করা
মাহে রমজানের শেষ দশকের যেকোনো রাত শবে কদর হতে পারে। তাই প্রত্যেকটি বেজোড় রাতে ইবাদত করা উচিত। এ রাতে পাঠ করার জন্য হাদিসে বর্ণিত একটি দোয়া রয়েছে।
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসুল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দোয়া পড়বো? তখন তিনি বললেন, তুমি বলো
اللَّهمَّ إنَّك عفُوٌّ كريمٌ تُحِبُّ العفْوَ، فاعْفُ عنِّي উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিম; তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।
অর্থ : হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫১৩)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।