জুমবাংলা ডেস্ক : রাজশাহী মহানগরীর দৃষ্টিনন্দন সড়কগুলোর একটি গ্রেটার রোড বন্ধগেট থেকে সিটি হাট পর্যন্ত। সাড়ে তিন কিলোমিটার এই সড়কটি গেল তিন বছরের মধ্যে চার লেনে উন্নীত করার পাশাপাশি সড়ক বিভাজক, আলোকায়নসহ দৃষ্টিনন্দন লাইটস দিয়ে প্রশস্ত ফুটপাথ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন সড়টির সেই ফুটপাথ যেন হয়ে উঠেছে রীতিমতো মৃত্যু ফাঁদ।
পুরো সড়কের পূর্বের অর্ধেক অংশ সিটি হাট থেকে ডাবতলা পর্যন্ত অন্তত দুই কিলোমিটারের দুপাশের ফুটপাথে ঢাকনাবিহীন ড্রেন থাকায় এটি দিয়ে আর চলাচল করতে পারছে না নাগরিকরা। এ ছাড়া এদিকটাতে অপেক্ষাকৃত কম জনবসতি ও দোকানপাট না থাকায় ড্রেনের ইস্পাতসহ কনক্রিটের ঢাকনা চুরি করে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ফলে সড়কটির ফুটপাত একেবারেই চলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এখন।
সিটি হাট থেকে পশ্চিমে নগরীর বর্ণালী মোড়। সেই পথে এই সড়কটির শেষ গন্তব্য বন্ধগেট হয়ে গ্রেটার রোড। শুধু হাটবার বুধবার ও রোববার বাদে সড়কের এ পাশে খুব একটা বেশি লোকজন দেখা যায় না। সন্ধ্যার পর কিছু মানুষ আলোকায়ন দেখতে এই ফুটপাতগুলোতে বসে সময় কাটাতেন।
খুব সকালে হাঁটতে আসা নগরবাসী এই পথ দিয়ে নিয়মিত চলাচল করেন। তেমনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবুল হাসনাত। স্ত্রীকে নিয়ে নিয়মিত এই পথে হাঁটেন তিনি। আফসোস করে বলছিলেন, ‘দেশের মানুষের আক্কেল এতই কম যে নতুন তৈরি করা ফুটপাথের ওপর বসানো ড্রেনের ঢাকনাগুলো একটাও বাকি রাখেনি। অথচ মাস তিনেক আগেও এই ফুটপাত দিয়ে নিয়মিত হাঁটতে পারতেন তিনি। পরে ধীরে ধীরে সবই চুরি হয়ে গেছে।
সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে আলোয় ভরা সড়কের পাশের ফুটপাতে নিরিবিলিতে বসে আড্ডা দিতেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লাবীব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গত কুরবানির ঈদের পর থেকেই এই ড্রেনের ঢাকনা বা স্ল্যাব চুরির ঘটনা শুরু হয়েছে। এটি করপোরেশন তদারকিতে রাখলে সড়কটির আজ এই হাল হতো না। এখন রাতের বেলা এই ফুটপাত দিয়ে চলা জীবন মরণের প্রশ্ন। ৩ ফিট পর পরই বড় বড় ঢাকনার স্থান, যেগুলো এখন পুরোপুরি ফাঁকা। যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এখন এখানে বসাই দায়।
সড়কটির সিটি হাট থেকে একটু সামনে নেসকো বিমানবন্দর ডিভিশন কার্যালয়ের সামনে ফুটপাতে বিকেল বেলা চটপটির দোকান দিতেন করিম উদ্দিন। তার ভাষ্য, দিনে দুপুরে মাদকসেবীরা এই স্ল্যাবগুলো ভ্যান বা অটোরিকশা করে তুলে নিয়ে যায়। দেখার কেউ নেই। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এই প্রবণতা আরও বাড়ে। দেখার কেউ না থাকায় শত শত স্ল্যাব এখান থেকে হরিলুট হয়েছে। নতুন ফুটপাতের টাইলস ভেঙে রড কেটে তারা স্ল্যাবের ঢাকনা ভিড়িয়ে রাখার স্থানের চতুর্ভুজ স্পাতটিও তুলে নিয়ে গেছে। করিমের মতে ফুটপাথ নষ্ট হবার পর তিনি আর এই ব্যবসা করতে পারছেন না।
২১ অক্টোবর সকাল থেকে সন্ধ্যা, এ প্রতিবেদক পুরো একটা দিন সড়কটিতে ঘুরে ঘুরে এই দুর্বৃত্তায়নের খোঁজ করেছেন। সিটি হাট এলাকা থেকে দক্ষিণমুখি যে সড়কটি সামনের দিকে এগিয়েছে সেই সড়কের বামে যে ৫ ফিট গভীর ও ৪ ফিট চওড়া ড্রেন তার ওপর দুই ফিট বাদ রেখে ঢালাই ও মাঝে মাঝে ঢাকনা দিয়ে ফুটপাথ ঢেকে দেয়া হয়েছে টাইলস দিয়ে। অপরদিকে সড়কটির ডান পাশে ৫ ফিট গভীর ও ৫ ফিট লম্বা ও ৩ ফিট চওড়া ড্রেন তার ওপর এক ফিট বাদ রেখে ঢালাই ও মাঝে মাঝে বড় বড় ঢাকনা দিয়ে ফুটপাথ ঢেকে দেয়া। দুপাশে ছোট ও বড় ঢাকনা রয়েছে। ঢাকনাগুলো কনক্রিটের অন্তত আড়াই ইঞ্চি পুরু ভেতরে ভালো মানের রড দেয়া। চারিপাশে ত্রিকোণ ইস্পাত এঙ্গেল দিয়ে বর্ডার দেয়া যাতে ভেঙে না যায়। মাঝে দুটি হাতল রাখার স্থান রয়েছে, সেগুলোও ইস্পাতের তৈরি। এ ছাড়া ঢাকনাগুলো ভিড়িয়ে রাখবার যে স্থান সেখানেও চারপাশে ত্রিকোণ ইস্পাত এঙ্গেল ব্যবহার করা রয়েছে। যেগুলো ড্রেনে ব্যবহার করা মোটা রডের সঙ্গে ঝালাই করে যুক্ত করা।
ড্রেনগুলোতে পানি প্রবাহ রয়েছে, ভেতরে কনক্রিট ভাঙার নমুনা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ওপরে দুপাশে রড কেটে ইস্পাত বের করার স্পষ্ট চিহ্ন। তা করতে গিয়ে ফুটপাতের টাইলস ভেঙে ফেলেছে তারা। হিসেব মতো দুই কিলোমিটার দূরে ডাবতলা পর্যন্ত এমন ছোট বড় মাপের ইস্পাত মিলিয়ে ড্রেনের স্ল্যাব খোয়া গেছে অন্তত ৬০০টি।
খোঁজ খবর নিয়ে স্থানীয় একজন জানালেন, পাশেই কয়েরদাঁড়া, মালদা কলোনি এলাকা। সেখান থেকে অনেক চোর ও মাদকসেবী হাতে রড কাটার একটি লম্বা ব্লেড আর একটি হাতুড়ি নিয়ে এসেই এগুলো তুলে নিয়ে যেতে পারে। এই কনক্রিট তুলে নিয়ে গিয়ে তা ভেঙে যে পরিমাণ ইস্পাত ও রড বের হয় তাতে ভাঙারির দোকানে বড় একটি স্ল্যাব থেকে তারা ন্যূনতম ৫০০টাকা, আর ছোটটি থেকে করে ৩০০ টাকা পেতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ব্যক্তি জানান, সম্প্রতি বেশ কয়েকজনকে অটোরিকশায় তুলে স্ল্যাব নিয়ে যাবার সময় বটতলায় স্থানীয়রা আটকান। তারা আবার জরিমানার টাকা নিয়ে তাদের ছেড়েও দেন।
বিষয়টি জানার পর সুশাসন বিশ্লেষক সুব্রত কুমার পাল বলেছেন, সড়কটি তৈরির পর এর রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা এর টেকসই উন্নয়ন নিয়ে হয়তো পরিকল্পনা করেননি প্রকৌশলীরা। নগরীতে যতটা দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে তা টেকসই উন্নয়ন নয়।
এই বিশ্লেষক প্রশ্ন রাখেন, নাগরিকরা কেন স্ল্যাব চুরি করে নিয়ে যাবে সেই উত্তর আগে খুঁজে বের করতে হবে প্রকৌশলীদের, তার পরে সেই উপযোগী করে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা উচিৎ যাতে নির্মাণটি অন্তত ১০ বছর টেকসই হয়।
অন্যদিকে ক্যাব রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, বিগত সরকারের সময়ে যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই এমন নড়বড়ে উন্নয়নের নমুনা আমরা দেখেছি। এমন এক সড়ক আর ফুটপাত তৈরি করেছে যে উদ্বোধনের বছরখানেকও টেকে না। সবাইকে বিচারের আওতায় আনার দাবি তোলেন তিনি। এ ছাড়াও সম্পদের সুষম বণ্টন ও সমস্যার ভালো মানের স্থায়ী সমাধানও আশা করেন গোলাম মোস্তফা।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ও সমাধান জানতে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আহমদ আল মঈনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে টেলিফোনে তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের জরুরি কাজে তিনি ঢাকায় আছেন, আসতে দেরী হবে।
সড়কটির স্ল্যাবের বিষয়ে কথা তুলতেই তিনি বলেন, ‘আপনারও যেই সেন্টিমেন্ট কাজ করছে আমারও ঠিক তাই। এটি বন্ধ করবো কিভাবে, সেটিই ভাবছি। আপনারা কিছু একটা করেন, চোর ধরার ব্যবস্থা করেন বাকিটা আমরা দেখছি।’
এ পর্যন্ত কতগুলো ড্রেনের স্ল্যাব চুরি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘মোট পৌনে ৬শ’ (৫৭৫) স্ল্যাব রয়েছে। চুরি হয়েছে পাঁচশরও অধিক। আমরা মামলা বা জিডি করব দ্রুতই, মনে হয় ম্যাজিস্ট্রেট শাখা থেকে মামলাটা করেই ফেলেছে। তারপরই পুলিশ কি রিপোর্ট দেয় দেখি।’
অবশ্য বোয়ালিয়া থানায় এ সংক্রান্ত করপোরেশনের করা কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নগরীর বন্ধগেট থেকে সিটি হাট পর্যন্ত দুই লেন সড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণ কাজের উদ্বোধন করেন সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ৩.৫৩২ কিলোমিটার সড়কটি ৪৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮০ ফুট প্রশস্ত করা হয়। উভয় পাশে ২২ ফুট করে ৪৪ ফুট রাস্তা, রাস্তার উভয় পাশে ৬ ফুট করে মোট ১২ ফুট ড্রেন ও ফুটপাত, ফুটপাত ও ড্রেনের উভয় পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট স্লো মুভিং ভিহেকেল রাস্তা, রাস্তার মাঝে ৪ ফুটের ডিভাইডার আলোকায়নসহ নির্মাণ করা হয়। সূত্র : চ্যানেল 24
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।