জুমবাংলা ডেস্ক : এক সময় পুরো লক্ষ্মীপুর জেলার অধিকাংশ এলাকা ছিল মেঘনা নদীর দখলে। যখন পানি শুকিয়ে নদী চলে যায় জেলার পশ্চিমাংশে, তখন চর জেগে তৈরি হয় মূল ভূ-খণ্ডের। এর মধ্যে পানি শুকিয়ে একটি বিস্তীর্ণ জমিতে প্রায় ৭০ বছর আগের দুটি বয়া দেখা যায়। আর বয়ার নামেই গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘বয়ারচর’।
কিন্তু হাতলসহ মোটকা সদৃশ লোহার বস্তুগুলো নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। একেকজন একেকভাবে এ নিয়ে তথ্য উপস্থাপন করেন। তা এখন পড়ে আছে ফসলি ক্ষেতে পরিত্যক্ত অবস্থায়। তবে প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা হলে বয়াগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করছে সচেতন মহল।
সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ এলাকার চরউভূতি গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠের মাঝখানে মাটির নিচে পোঁতা রয়েছে দুটি লোহার মোটকা সদৃশ বস্তু। তবে মাটির নিচে কতটুকু আছে তা কেউই বলতে পারছেন না। ওপরে রিংয়ের মতো হাতল আর মোটকা সদৃশ বস্তুগুলো দেখতে অনেকটা গ্যাস সিলিন্ডারের মতো। প্রায় ৭০ বছর ধরে মাটিতে পুঁতে রাখা বস্তুগুলো মরিচা ধরে ক্ষয়ে পড়ছে।
জানা গেছে, বয়া থাকার কারণে চরউভূতি গ্রামের একটি অংশের নাম বয়ারচর হিসেবে সুপরিচিত। প্রতিদিন বয়াগুলো দেখলেও তা নিয়ে স্থানীয়দের কৌতূহল আজও কিন্তু কমেনি। তারাও জানতে চায় এ বয়ার সঠিক রহস্য। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানতে পেরে অনেকেই ছুটে যান বয়াগুলো দেখতে। বয়াগুলো কীভাবে, কবে ও কারা স্থাপন করেছে তা জানার আগ্রহ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে এই বয়া নিয়ে একেকজন একেক ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। কেউ বলছেন নদী পথে নৌযান চলাচলের দিক-নির্দেশনার জন্য বয়াগুলো স্থাপন করা হয়। তবে তা থাকে ভাসমান। আবার অনেকেই বলেন প্রচণ্ড ঝড়ে বয়াগুলো তেওয়ারীগঞ্জের বিস্তীর্ণ মাঠে পড়ে। আবার পূর্ব পুরুষের বরাত দিয়ে স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা মমিন উল্যাহ, আব্দুল আলীসহ কয়েকজন জানিয়েছেন, বয়াগুলো চরউভূতি গ্রামে পড়ার পর পানি শুকিয়ে বিশাল চর জাগে। এরপর মানুষ চাষাবাদ করতে গেলে বয়াগুলো দেখতে পায়। বয়াকে কেন্দ্র করে চর জাগা নিয়ে অলৌকিক কিছু রয়েছে বলে মানুষের মাঝে কুসংস্কার জন্ম নেয়। এরপর দূর-দূরান্ত থেকে এসে মানুষজন মানত করতো ও মিলাদ পড়াতো। তবে কালের বিবর্তনে এখন এসব নেই বললেই চলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, তেওয়ারীগঞ্জ, কুশাখালীসহ আশপাশের এলাকায় নদী ছিল। তৎকালীন নোয়াখালী জেলার কুশাখালীর ফরাশগঞ্জ ছিল নৌবন্দর। শত বছর আগে এ অঞ্চলটি ধীরে ধীরে চর হয়ে উপজেলার পশ্চিম অংশে নদী সরে যায়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, এ অঞ্চলে যখন নদী ছিল, তখন নদীর নৌযান চলাচলের দিক-নির্দেশনায় যে বয়া স্থাপন করা হয়েছে, এ দুটি বয়া তখনকার সময়ের। ফরাশগঞ্জ নৌ বন্দরে বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। জাহাজ ভিড়ানো জন্য ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে কয়েকটি বয়া স্থাপন করে। সেগুলোর মধ্যে এ দুটি বয়াও ছিল। নদী সরে গিয়ে এলাকায় চর জেগে তখন বয়াগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। তবে কালের বিবর্তনে সেগুলোর ওপর থেকে মাটি সরে গিয়ে ওপরের অংশ দৃশ্যমান হয়।
মমিন উল্যাহ নামে এক বৃদ্ধ বলেন, বয়াগুলো প্রায় ২০-২৫ ফুট উঁচু ছিল। মাটিতে তা মরিচা ধরে ক্ষয়ে গেছে। স্থানীয়রা নয়, অন্য জায়গা থেকে লোকজন এসে মানতসহ মিলাদ মাহফিল করতো।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল আলী বলেন, ‘এখানে নদী আছিলো। বয়া বৈয়ানের (বসানো) হর (পর) চরদি (চর জেগে উঠে) গেছে। চাইরো দিকে লোহার বেড়া আছিলো। টাওয়ারের মতো ওপরের দিকে উডা (উঠা) যাইতো। প্রায় ১৫-২০ আত (হাত) উঁচা (উঁচু) আছিল। মাইঝখান বরাবর বৈঠকখানা ছিল। উপরে ওজ্ঞা (একটা) পিতলে খোরা (বাটি) আছিলো। মাইনষে নিয়ত করি আনি খোরাত দিতো। হোলাইনে আবার লই যাইতো। আমরা কত হয়সা (পয়সা) আনি খাইছি, কত সিন্নি আনি খাইছি। তলেদি (মাটির নিচে) মোটকা কতটুক আছে এডা আমরা কইতে হাইরতাম ন।’
একই এলাকার বাসিন্দা মো. শাহজাহান বলেন, এখানে নদী ছিল। বড় বড় জাহাজ-নৌকা চলতো। এক সময় এখানে বয়াগুলো এসে পড়ে। এরপর পানি শুকাতে শুরু করে। চর জেগে ওঠে। দেখা মেলে বয়াগুলোর। পরে মানুষজন বিভিন্ন মানত করে মিলাদ পড়াতো, সিন্নি দিতো। টাকা-পয়সা দিয়ে গেলে পোলাপাইন নিয়ে যায়। অনেকেই এসে সালাম করতো, বয়ার পাশের মাটি নিয়ে যেত। যা দিয়ে তাবিজ বানাতো। এখন আর আগের মতো কেউ মানত কিংবা মিলাদও পড়ায় না।
লক্ষ্মীপুর ডায়েরির লেখক সানাউল্লাহ সানু বলেন, বয়াগুলোর বয়স কত তা জানা যায়নি। ১৯৫৫ সালে ভাষাসৈনিক কমরেড তোয়াহা লক্ষ্মীপুর থেকে রামগতিতে বেড়িবাঁধ (লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক) দেয়। এরপর ঘটনাস্থল থেকে মেঘনা নদী প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমে চলে যায়। এরপর থেকেই বয়াগুলো পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু কখন এসেছে, কারা স্থাপন করেছে বা কী জন্য আনা হয়েছে তা কেউই বলতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, যখন ঘটনাস্থল মেঘনা নদী ছিল। তখন কোথাও থেকে ঝড়ে বয়াগুলো এখানে এসে পড়েছে। আবার আরেকজন বলেছেন নদী বা সাগরে নৌযান চলাচলের দিক নির্ণয় এবং সীমানা নির্ধারণের জন্য বয়াগুলো স্থাপন করা হয়। অর্থাৎ বয়ার একদিকে নৌযান চলাচল করতে পারতো, অন্যদিকে পারতো না। প্রায় ৭০ বছর ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা বয়াগুলো দেখে আসছে। বয়াগুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষনীয় ও গবেষণার বিষয়। এটি জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরবে। এতে বয়াগুলো যেন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বয়া সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নদীতে বা সাগরে নৌযান চলাচলে নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ধরনের দিক-নির্দেশক চিহ্ন স্থাপন করে নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে বয়া প্রাচীন একটি চিহ্ন। নদীতে পণ্যবাহী জাহাজ, ফেরি, লঞ্চ, স্টিমারসহ অন্যান্য নৌযান বিপদ থেকে রক্ষায় বয়া যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গোলাকার একটি লৌহ দণ্ডের সঙ্গে নদী বা সাগরের গভীর তলদেশে শিকল ও অ্যাংকর দ্বারা সংযুক্ত করা হয়। ফলে বয়া ওই স্থান থেকে সহজে সরে না। বয়ার পাশাপাশি এখন নদীতে বিকন বাতিও স্থাপন করা হচ্ছে।
সূত্র ও ছবি : ঢাকা পোস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।