সাইফুল হোসেন : মানুষের অনেক ধরনের অভ্যাস আছে; কোনোটা ভালো, কোনোটা খারাপ। টাকা-সংক্রান্ত খারাপ অভ্যাস কিছু মানুষের মধ্যে এমনভাবে প্রোথিত, তারা সেসব খারাপ অভ্যাস থেকে বের হতে পারছেন না। আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে চাইলে আপনাকে টাকা-সংক্রান্ত নিচের ৮টি কুঅভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
এক. নিজেকে সর্বশেষে পেমেন্ট করা
আমরা সবাই জানি, নিজেকে আগে পেমেন্ট করা উচিত। কিন্তু এখানে আমি বলছি, যারা সবশেষে নিজেকে পেমেন্ট করেন তারা ভুল করেন। কিছু মানুষ আছেন যারা পুরো মাস খরচ করার পর যদি কিছু টাকা হাতে থাকে, সেই টাকা সঞ্চয় করেন। এটি অনেক বড় কুঅভ্যাস। আপনি যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে চান; যদি নগদ অর্থের অভাবে ভুগতে না চান, তাহলে আপনাকে ‘পে ইউর সেলফ ফার্স্ট’ করতে হবে। অর্থাৎ নিজেকে আগে পেমেন্ট করতে হবে। আপনার আয়ের ১০ শতাংশ হোক বা ২০ শতাংশ; বয়স অনুসারে একটা অংশ আপনি আগে সঞ্চয় করবেন। তার পর যে টাকাটা থাকবে সেটা খরচ করবেন।
দুই. মন্দ ঋণ নিয়ে খুব আরামদায়ক অবস্থানে থাকা
ঋণ দুই ধরনের। একটি ভালো ঋণ, আরেকটি মন্দ ঋণ। যে ঋণ থেকে আপনি আরও টাকা আয় করতে পারবেন সেটা হচ্ছে ভালো ঋণ। ধরুন, কিছু টাকা নিয়ে আপনি একটি ব্যবসা শুরু করলেন বা কোনো একটা জিনিস কিনলেন। এক মাস পর আপনি সেটির ১০ শতাংশ বা ২০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করে দিলে আপনার মূলধন সৃষ্টি হলো। ঋণের সুদ পরিশোধ করার পরও আপনার হাতে যদি কিছু নগদ টাকা থাকে তাহলে ওই ঋণ আপনার ভালো ঋণ। অন্যদিকে মন্দ ঋণ হচ্ছে, যে ঋণ নিয়ে আপনি খরচ করে ফেলছেন এবং যা থেকে আপনার কোনো আয় হচ্ছে না বরং আয় থেকে ঋণ পরিশোধে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দ ঋণ হচ্ছে আপনার ক্রেডিট কার্ড। যেগুলোতে ২২ থেকে ৪০ শতাংশ দিতে হয় সুদসহ। আপনি যখন মন্দ ঋণের সঙ্গে খুব বেশি আরামদায়ক অবস্থানে থাকছেন, তখন আপনি আর ধনী হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করতে পারছেন না। ফলে এই অভ্যাস থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তিন. কোনো আপৎকালীন টাকা বা ইমার্জেন্সি ফান্ড না থাকা
আপনারা যেটা করবেন সেটা হচ্ছে, তিন মাস থেকে ছয় মাস বা এক বছরের জন্য আপনার দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে যে টাকাটা দরকার হয়, সেই টাকাটা এক পাশে সরিয়ে রাখবেন। আপনি টাকাটা রেখে দেবেন। এই টাকাটা খরচ করার প্রয়োজন নেই। এই টাকা শুধু তখন খরচ করবেন, যখন আপনি প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে পড়বেন। ধরুন, আপনার চাকরি নেই অথবা এমন অসুস্থ হয়েছেন, আপনি আর আয় করার পথে ফিরতে পারছেন না। এই সময়ে আপনি কী করবেন? ওই ইমারজেন্সি ফান্ডের টাকা ভাঙবেন। অনেকেই একটু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বলেই ইমারজেন্সি ফান্ড ভেঙে ফেলছেন। এটা করা যাবে না। তখন আপনি খরচের মধ্যে সমন্বয় করবেন। পরবর্তী সময়ে আবার যখন আপনি কাজে ফিরবেন, তখন ইমারজেন্সি ফান্ডটা গঠন করে ফেলবেন আগে। যাদের এই ইমারজেন্সি ফান্ড নেই, তারা সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যান জীবনের কোনো না কোনো সময়।
চার. নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাব না থাকা
আপনি এতটাই ব্যস্ত যে, জানেনই না আপনার আয় কত আর ব্যয় কত? হয়তো বলবেন, আপনি নিজের আয় জানেন। কারণ আপনি একটা উৎস থেকে আয় করছেন, যদিও কেউ কেউ দুই-তিনটা উৎস থেকেও আয় করে থাকেন।
যখন আপনি আয় জানেন কিন্তু ব্যয় জানেন না, তখন সেটা ভয়াবহ। আপনার আয় যদি হয় ৫০ হাজার টাকা; জানতে হবে– কত টাকা ব্যয় হচ্ছে। প্রথমেই যদি আপনি নিজেকে পেমেন্ট করে ১০ বা ২০ পার্সেন্ট এক পাশে সরিয়ে রাখেন, তাহলে বাকি টাকাটা খরচ করতে পারবেন। যারা তাদের আয় ও ব্যয় সঠিকভাবে জানেন না, বিশেষত কোন কোন খাতে কত টাকা যাচ্ছে, তারা ধীরে ধীরে সংকটের মধ্যে পড়েন। দুটো কারণে জানা দরকার। একটা হচ্ছে খরচ কমানো; দ্বিতীয়টা, পরবর্তী মাসে খরচের মূল্যায়ন করার পর বোঝার জন্য, কোন খাতে আপনার কত খরচ হয়েছে।
পাঁচ. অত্যন্ত ব্যয়বহুল শখ থাকা
অনেকের দামি দামি শখ আছে। যেমন কেউ মাসে একাধিকবার ঢাকার বাইরে চলে যান; কেউ আছেন সপ্তাহে একদিন ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে আউটিংয়ে যান। আবার কেউ মাসে এক দিন ফ্লাই করতে পছন্দ করেন। যাদের এ রকম একাধিক ব্যয়বহুল শখ আছে, তাদের প্রতি মাসে অনেক টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। আমি বলছি, আপনি খরচ তো অবশ্য করবেন, কিন্তু জেনেবুঝে। সেই খরচ যেন খামখেয়ালির বশে না হয়। এমন যেন না হয়, আপনি অজান্তেই অনেক কিছু কিনে ফেলছেন, যা আপনার বিশেষ কোনো কাজে লাগছে না। আপনার আয় খুবই সীমিত। এই সীমিত আয় দিয়ে আপনার চলতে হবে; কিছু সঞ্চয় করতে হবে এবং কিছু বিনিয়োগ করতে হবে। বিকল্প দিকগুলো আপনাকে ভাবতে শিখতে হবে।
ছয়. শুধু সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করা
কিছু মানুষ আছেন যারা শুধু সঞ্চয় করছেন, তারা সঞ্চয়মুখী। ধরুন, টাকা যেটা আসছে, এবং খরচের পরে যেটা বেঁচে যাচ্ছে সেটা ব্যাংকে রাখছেন বা বিভিন্নভাবে সঞ্চয় করছেন। এটা একটা পুওর মানি হ্যাবিট। কারণ সঞ্চয় যখন আপনার হয়ে গেল, তখন এটিকে বিনিয়োগে রূপান্তরিত করতে হবে। সে জন্য আপনার জ্ঞান দরকার, প্রজ্ঞা দরকার। কোথায় কীভাবে কখন বিনিয়োগ করবেন, সেটা জানা দরকার। জরুরি তহবিল সঞ্চয় করার পর আপনার উচিত ছোট ছোট বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা। যদি বিনিয়োগ করেন এবং দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন, তাহলে এটি থেকে আপনার যে রিটার্ন আসবে তা সঞ্চয় থেকে কখনোই আসবে না। যারা শুধু সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করেন, তারা কিন্তু এটা বোঝেন না। ফলে তারা আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে পারেন না। ওই টাকা বেশি হারে বাড়ে না। তাই যারা শুধু সঞ্চয়ে থাকেন, তাদের এই অভ্যাসকে বলে ‘পুওর মানি হ্যাবিট’। যারা বিনিয়োগে যান তাদের এই অভ্যাসটা হচ্ছে ‘রিচ মানি হ্যাবিট’।
সাত. অনেক লম্বা সময় ধরে ইনভেস্টমেন্টের জন্য অপেক্ষা করা
যারা সঞ্চয়ী, তাদের যে বিনিয়োগ করার চিন্তা নেই– এমনটা নয়। তারা চিন্তা করতে করতে এমন লম্বা সময় নেন, তখন অনেক দেরি হয়ে যায় এবং বিভিন্ন সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হন। যিনি যত তাড়াতাড়ি বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকতে পারেন, তিনি তত ভালো করেন। তবে অন্যের কথা শুনে বিনিয়োগ করা যাবে না। নিজের মেধা খাটাতে হবে; ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি আপনার থাকতে হবে।
আট. ব্যক্তিগত ফিন্যান্স সম্পর্কে সতর্ক না থাকা
কিছু মানুষ আছেন, খামখেয়ালিপনার মধ্যে থাকেন। নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে উদাসীন থাকলে চলবে না। নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনা অভ্যাসের কাজ। এটি দীর্ঘ সময় ধরে শিখতে হয়। স্কুল-কলেজে এগুলো শেখায় না। এ-সংক্রান্ত অর্জিত জ্ঞান আপনাকে ব্যবহার করতে হবে নিজের সম্পদ বাড়ানোর জন্য। নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনা যদি আপনি সঠিকভাবে করেন; সম্পদ এমনিই বাড়বে। আমি বলি না– চুরি করে বা অন্যেরটা আত্মসাৎ করে সম্পদ বাড়ান। আমি বলছি, আপনি আপনার সারাজীবনের অর্জিত অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা করুন। আপনি নিজে এটি করুন এবং যদি পারেন অন্যদের করতে সাহায্য করুন।
সাইফুল হোসেন: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।