ধর্ম ডেস্ক : মাহে রমজান কোরআন নাজিলের মাস। তাই রমজানের সঙ্গে কোরআনের সম্পর্ক নিবিড়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সুপথপ্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোজা রাখে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)
বিশুদ্ধভাবে কোরআন পড়া, কোরআনের শিক্ষা অর্জন করা এবং কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন গড়া রমজানের অন্যতম শিক্ষা। রমজান ও কোরআনের উদ্দেশ্যও এক। তা হলো তাকওয়া অর্জন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো’ (সুরা বাকারা: ১৮৩)
রমজানের মতো কোরআনও বান্দার তাকওয়া অর্জনে ভূমিকা পালন করে। ইবনে হাজার (রহ) বলেন- কোরআন তেলাওয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য আত্মিক উপস্থিতি ও উপলব্ধি। (ফাতহুল বারি: ৯/৪৫) ইবনে বাত্তাল (রহ) বলেন, রাসুলের কোরআন শিক্ষা ও অনুশীলনের একমাত্র কারণ ছিলো পরকালের আকাঙ্ক্ষা ও ব্যাকুল ভাবনার জাগরণ এবং পার্থিব বিষয়ে অনীহার সৃষ্টি করা। (ইবনে বাত্তাল, শরহে বুখারি: ১/১৩)
পবিত্র রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ (স.) রমজান মাসে কোরআন তেলাওয়াত বাড়িয়ে দিতেন এবং ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে নববিতে সাহাবিদের কোরআন শিক্ষা দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়েই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি: ৬)
হাশরের ময়দানে বান্দার মুক্তির জন্য রোজা ও কোরআনের ভূমিকা থাকবে বেশি। নবীজী (স.) বলেন, ‘কোরআন ও রোজা আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও মনের খায়েশাত মিটানো থেকে বিরত রেখেছিলাম। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব আমাদের সুপারিশ কবুল করুন। তখন আল্লাহ তাআলা সুপারিশ কবুল করে নিবেন।’ (মুসনাদে আহমদ) সহিহ মুসলিমে আবু উমামা আল বাহিলি (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেন, ‘ তোমরা কোরআন পড়ো, কেননা তেলাওয়াতকারীদের জন্য কোরআন সুপারিশকারী হিসেবে আসবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪)
সহিহ ইবনে হিব্বানে এসেছে, ‘কোরআন এমন সুপারিশকারী যার সুপারিশ কবুল করা হবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পথপ্রদর্শক বানাবে কোরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পশ্চাতে ফেলে রাখবে কোরআন তাকে জাহান্নামে পাঠাবে।’ (ইবনে হিব্বান: ১২৪)
পবিত্র কোরআন না বুঝে পড়লেও সওয়াব আছে। কারণ এটি একটি পৃথক ইবাদত। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি অক্ষর তেলাওয়াত করল তার বিনিময়ে সে একটি নেকি পাবে, আর একটি নেকির বিনিময় হবে ১০ গুণ। এ কথা বলছি না যে আলিফ-লাম-মিম একটি অক্ষর, বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মিম একটি অক্ষর।’ (তিরমিজি: ২৯১০)
রমজান মাসে সওয়াব অনেক গুণ বৃদ্ধি করা হবে এবং আল্লাহ তাআলা যত ইচ্ছা ফজিলত দান করবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- ‘মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকির সওয়াব দশগুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, কিন্তু রোজা আলাদা। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে ‘ (সহিহ মুসলিম: ১১৫১; মুসনাদে আহমদ: ৯৭১৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৮৯৮৭; ইবনে মাজাহ: ১৬৩৮)
এই হাদিসে আমরা দেখতে পাই, সাধারণত বান্দার নেক আমল দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে সাওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়, আর রমজানে এটা আরো বৃদ্ধি পায়।
ফলে একজন মুসলমানের জন্য রমজান কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সোয়াব অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আসে। একজন সুস্থ সবল মুসলমান হয়েও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করা অনুচিত। রাসুলুল্লাহ (স.) যেমন রমজানে অধিক কোরআন তেলাওয়াত করতেন, তেমনি মুসলিম মনীষীদের জীবনীতেও রমজান মাসে অধিক হারে কোরআন তেলাওয়াতের বর্ণনা রয়েছে। যেমন—
হজরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) প্রতি রাতে পূর্ণ এক খতম কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করতেন। (শরহু ইবনে বাত্তাল: ৩৯০/২)
ইবনে মাসউদ (রা.) রমজানে তিন রাতে পুরো কোরআন তেলাওয়াত করতেন। (আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি, বর্ণনা: ৪০৫৯)
তামিমে দারি (রা.) রমজান এলে সাত রাতে আর উবাই ইবনে কাআব (রা.) আট রাতে পুরো কোরআনুল করিম তেলাওয়াত করতেন। (আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি, বর্ণনা: ৪০৫৯) অন্য বর্ণনামতে, তামিম দারি (রা.) রমজানের রাতে পূর্ণ কোরআন খতম করতেন। (শরহু ইবনে বাত্তাল: ৩৯০/২)
কাতাদাহ (রহ.) প্রতি সপ্তাহে কোরআন খতম করতেন আর রমজান এলে প্রতি তিন দিনে খতম করতেন এবং শেষ দশক এলে প্রতি রাতে কোরআন খতম করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৭৬)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রত্যেক দিন ও রাতে কোরআন খতম করতেন এবং যখন রমজান মাস আসত, তখন তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ও রাতসহ সর্বমোট ৬২ বার কোরআন খতম করতেন। (আখবারু আবি হানিফা ওয়া আসহাবিহি, পৃষ্ঠা ৫৫)
ইমাম শাফেয়ি (রহ)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তিনি প্রতি রাতে এক খতম করতেন এবং যখন রমজান আসত, তখন রাতে এক খতম এবং দিনে আরেক খতম করতেন। ফলে তিনি রমজান মাসে মোট ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। (তারিখে দামেস্ক লি ইবনে আসাকির, খণ্ড ৫১, পৃষ্ঠা ৩৯২)
এস আলম পরিবার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ১১ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
ইমাম বুখারি (রহ.) সাহরিতে কোরআনের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ তেলাওয়াত করতেন এবং প্রতি তিন রাতে সাহরিতে কোরআন খতম করতেন এবং প্রতিদিন দিনের বেলায়ও কোরআন খতম করতেন। আর এই খতম ছিল ইফতারের সময় এবং তিনি বলতেন যে প্রত্যেক খতম শেষে দোয়া কবুল হয়। (তারিখে বাগদাদ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩১)
এমনই ছিল মুসলিম মনীষীদের কোরআনময় রমজান। তাই আমাদে উচিত বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা এবং কোরআনময় জীবন গড়া। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।