ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথম ধাপে ৩০০ জন ‘মাস্টার ট্রেইনার’ তৈরি করা হচ্ছে, যাঁরা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) উদ্ভাবিত ই-রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
এই প্রকল্পে ডিএনসিসি ৫৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় করছে প্রশিক্ষক তৈরির জন্য। একইসঙ্গে ই-রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণে ব্যবহারের জন্য ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর কেনা হবে ৬ কোটি টাকায়। শিগগিরই এ বিষয়ে টেন্ডার আহ্বান করা হবে।
তবে এত বড় ব্যয়ের পরেও রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অবৈধভাবে তৈরি অটোরিকশা বন্ধ না করে শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা আনা কঠিন হবে। তাই প্রথমে এসব অবৈধ রিকশা উৎপাদন বন্ধ করা জরুরি।
এর আগেও ২০২৩ সালের ৫ আগস্টের আগে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ডিএনসিসি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), তবে কার্যত সফলতা আসেনি। সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ডিএনসিসি আবার অভিযান চালাতে গেলে বিভিন্ন এলাকায় চালকরা বিক্ষোভ করে রাস্তা অবরোধ করেন।
এর পর স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুই সিটি করপোরেশন মিলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ নেয়। বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগ একটি নিরাপদ, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এবং উন্নত ই-রিকশা তৈরি করেছে, যা এ মাসেই পরীক্ষামূলকভাবে পল্টন, ধানমন্ডি ও উত্তরায় চালু করা হবে। এসব রিকশার সম্ভাব্য মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির পরিবহন বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমান রাস্তায় চলাচলকারী রিকশাগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হবে এবং নতুন মডেলের ই-রিকশা চালুর জন্য চালকদের এক বছর সময় দেওয়া হবে। চালকদের এই রিকশা কেনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ঋণ দেবে।
এই ই-রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণের আগেই ৩০০ জন প্রশিক্ষক তৈরি করছে ডিএনসিসি। এর মধ্যে ১০০ জন পুলিশ সদস্য এবং বাকি ২০০ জন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের তালিকা থেকে নেওয়া হয়েছে। এই ২০০ জনের মধ্যে ১৭৫ জন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী, বাকি ২৫ জন বিভিন্ন কর্মসূচির প্রশিক্ষক।
২৮ জুন ডিএনসিসির নগর ভবনে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনদিনব্যাপী প্রশিক্ষণে ২০০ জন প্রথম ধাপে অংশ নেন এবং পরে বাকি ১০০ জনের প্রশিক্ষণও সম্পন্ন হয়। প্রশিক্ষণে ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রাম পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে।
ডিএনসিসির এক হিসাব কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে প্রশিক্ষকদের ভাতা দেওয়া হয়েছে এবং খাবার-নাশতার ব্যবস্থাও ছিল। প্রশিক্ষণ শেষে মাঠপর্যায়ে কাজে নামার আগে প্রতিটি মাস্টার ট্রেইনারকে একটি ল্যাপটপ ও একটি প্রজেক্টর দেওয়া হবে। প্রতিটি সেটের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ টাকা।
ল্যাপটপ ও প্রজেক্টরের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক মতিউর রহমান বলেন, প্রশিক্ষণ চলাকালে ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনার জন্য প্রজেক্টর প্রয়োজন। চালকদের ট্রাফিক চিহ্ন, দুর্ঘটনার কারণ, যানজট এবং নিজের ও যাত্রীর নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করার জন্য ভিডিও উপস্থাপনা দেখানো হবে। আর প্রশিক্ষণের ডাটাবেজ তৈরি, মনিটরিং ইত্যাদির জন্য ল্যাপটপ দরকার।
ডিএনসিসির সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম জানান, ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর কেনার জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং কিছু আনুষঙ্গিক সামগ্রীও কেনা হবে। বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এত বড় ব্যয়ের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে। আগের কোনো উদ্যোগ সাফল্য পায়নি, তাই এবার বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনকে আরও কার্যকর হতে হবে। তবে বুয়েটের নতুন ই-রিকশা প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং পরিবেশ সুরক্ষায় তা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
২৮ জুনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রিকশাচালকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এখন তাদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈধ কাঠামোর মধ্যে আনা হচ্ছে, যা তাদের সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
প্রশিক্ষণে কী শেখানো হয়েছে
২৮-৩০ জুন তিনদিনের প্রশিক্ষণে মাস্টার ট্রেইনারদের ই-রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ শেখানো হয়। এর মধ্যে ছিল:
ট্রাফিক নিয়ম-কানুন
দুর্ঘটনার কারণ
সচেতনতা সৃষ্টি
ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনার কৌশল
প্রশিক্ষকের গুণাবলি
বুয়েটের ডিজাইন করা ই-রিকশার কারিগরি জ্ঞান
দ্বিতীয় দিনে প্রশিক্ষকরা কিভাবে চালকদের সামনে উপস্থাপন করবেন, তার অনুশীলন করানো হয় এবং শেষ দিনে ই-রিকশার টেকনিক্যাল দিক ব্যাখ্যা করা হয়।
বুয়েটের ই-রিকশার বৈশিষ্ট্য
বুয়েটের তৈরি ই-রিকশাগুলো বিদ্যমান ব্যাটারিচালিত রিকশার চেয়ে অনেক উন্নত। এগুলো নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী।
মূল বৈশিষ্ট্য:
সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিমি
হাইড্রোলিক ব্রেক
উন্নত যাত্রী নিরাপত্তা
৩২৫-৪২৫ কেজি বহনক্ষমতা
মাইল্ড স্টিল ও লাইটওয়েট অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম
অনুমোদিত চার্জিং পয়েন্ট থেকে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।