বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ সাত লাখ ৮০ হাজার কমেছে, যা মোট শ্রমশক্তির ১১ শতাংশ হ্রাসের সমান। এছাড়া, ২৫ শতাংশ নারী মাতৃত্বকালীন ছুটির পর কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। পারিবারিক চাপ, যানবাহন সুবিধার অভাব এবং বিরূপ কর্মপরিবেশ এই হ্রাসের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, পরিবহন সুবিধা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীকে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখতে পারে।
জরিপের তথ্য
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা সাত কোটি ২২ লাখ ৮০ হাজার, যা গত বছর ছিল সাত কোটি ৩২ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ, এক বছরে শ্রমশক্তি কমেছে ৯ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ৭০ হাজার, যেখানে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে সাত লাখ ৮০ হাজার। ২০২৩ সালে শ্রমশক্তিতে পুরুষ ছিল চার কোটি ৮০ লাখ ৪০ হাজার এবং নারী দুই কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার। গত বছরের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা চার কোটি ৮১ লাখ ১০ হাজার থেকে কমেছে, আর নারীর সংখ্যা দুই কোটি ৫০ লাখ ২০ হাজার থেকে কমেছে।
দুই বছরের ব্যবধানে (২০২২-২০২৩) পুরুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার, কিন্তু নারীর অংশগ্রহণ কমেছে ১৫ লাখ ৪০ হাজার। ২০২২ সালে শ্রমশক্তিতে নারীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ ৮০ হাজার। শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারেও নারীরা পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমানে পুরুষের অংশগ্রহণের হার ৮০.১৩ শতাংশ, আর নারীর হার মাত্র ৩৯.২০ শতাংশ। ২০২২ সালে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল ৪২.৭৭ শতাংশ, অর্থাৎ দুই বছরে এই হার ৩.৫৭ শতাংশ কমেছে।
শ্রমশক্তির বাইরে নারী
শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে ২১ লাখ ৯০ হাজার। বর্তমানে এই সংখ্যা চার কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার, যার মধ্যে নারী তিন কোটি ৭৬ লাখ এবং পুরুষ এক কোটি ১৯ লাখ ১০ হাজার। এক বছরে শ্রমশক্তির বাইরে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ১৬ লাখ ৯০ হাজার, আর পুরুষের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ লাখ। দুই বছরের ব্যবধানে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩১ লাখ, যেখানে পুরুষের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৯০ হাজার।
কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার এবং নারী দুই কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ, কর্মে নিয়োজিত পুরুষের সংখ্যা নারীর প্রায় দ্বিগুণ।
নারীর কর্মবিরতির কারণ
বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ নারী মাতৃত্বকালীন ছুটির পর চাকরিতে ফিরতে পারেন না। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
পারিবারিক চাপ: শিশু সন্তানের নিরাপত্তা ও যত্নের দায়িত্ব নারীদের কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে বাধা দেয়।
যানবাহন সুবিধার অভাব: নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে নারীরা কর্মস্থলে যাতায়াতে সমস্যার সম্মুখীন হন।
বিরূপ কর্মপরিবেশ: অনেক কর্মস্থলে নারীবান্ধব পরিবেশের অভাব রয়েছে, যা তাদের চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে।
কিছু নারী পারিবারিক ও সামাজিক চাপের কারণে চাকরি ছেড়ে দেন, আবার কেউ কেউ চাকরি ও সংসারের ভারসাম্য রক্ষার চাপে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন বলে জানিয়েছেন।
ব্র্যাকের পিপল কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ঊর্ধ্বতন পরিচালক মৌটুশি কবির জানান, কর্মবিরতি থেকে চাকরিতে ফিরতে চাওয়া নারীর সন্তানদের জন্য কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার ব্যবস্থা খুবই জরুরি। এজন্য পেশাজীবন থেকে ছিটকে পড়া নারীদের ফেরাতে ব্রিজ রিটার্নশিপ নামে একটি কার্যক্রম চালু করেছে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে অনেক নারী কর্মক্ষেত্র ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। ব্র্যাকের ব্রিজ রিটার্নশিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে ওই নারীদের কর্মজীবনে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই উদ্যোগটি কর্মজীবন থেকে বিরতি নেওয়া নারীদের পেশাজীবনকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন। এর মাধ্যমে ব্র্যাক এবং ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলোতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানি স্কয়ার ফুড ও বেভারেজ লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেছেন, নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে নারীর কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। নারীরা নিরাপদ স্বস্তিদায়ক সঠিক পরিবেশ পেল কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বে যেতে পারবেন বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। তিনি মনে করেন সম্ভব হলে প্রযোজনে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ব্যবস্থাও করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলছেন, সন্তান পালনসহ সংসারের সব কাজ সবার সমান ভাবে ভাগ করে নিতে হবে। কিন্তু আমাদের প্রচলিত ধারনায় আমরা সব দাযিত্ব নারীর বলে মনে করি ।ফলে নারী কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সব জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা যা করা হয়নি।
কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রতিদিনের সকাল একটি চ্যালেঞ্জ। চাকরি ও পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা তাদের জন্য কঠিন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সম্মিলিত সহযোগিতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, নিরাপদ পরিবহন এবং নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।