পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে নতুন ক্ষমতা ও আজীবন গ্রেপ্তার–মুক্তির সুযোগ দিয়ে ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করেছে। সমালোচকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত দেশটিকে আরও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দিকে ঠেলে দেবে।

বৃহস্পতিবার আইনে স্বাক্ষর হওয়া এই সংশোধনীতে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতগুলোর কাঠামো ও কার্যপ্রণালীতেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরকারপক্ষ বলছে, সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক কাঠামো আরও পরিষ্কার করা এবং আদালতের মামলার জট কমানোই এসব পরিবর্তনের লক্ষ্য।
পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। কখনো সরাসরি ক্ষমতা দখল, কখনো বা আড়ালে থেকে সরকার পরিচালনার ইতিহাস রয়েছে তাদের।
বিশ্লেষকরা এটিকে ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। অনেকেই মনে করছেন, নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতার পাল্লা আরও সেনাবাহিনীর দিকেই ঝুঁকছে।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এটা স্পষ্ট ইঙ্গিত—পাকিস্তান এখন আর হাইব্রিড নয়, পোস্ট–হাইব্রিড শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করছে। নাগরিক ও সামরিক ক্ষমতার ভারসাম্য এখন প্রায় একচেটিয়াভাবে সামরিক বাহিনীর হাতে।’
নতুন আইনে ২০২২ সাল থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা মুনির এখন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ওপরেও তত্ত্বাবধান করবেন। তাঁর ফিল্ড মার্শাল উপাধি থাকবে আজীবন এবং অবসরের পরও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পরামর্শে তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া যাবে। ফলে জনজীবনে দীর্ঘদিনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন তিনি—এমনটাই ধরে নেওয়া হচ্ছে।
সরকারপক্ষ দাবি করছে, এটি সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো স্পষ্ট করছে। সরকারি বার্তা সংস্থা এপিপি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের বরাত দিয়ে বলেছে—নতুন কাঠামো আধুনিক যুদ্ধের চাহিদা অনুযায়ী সামরিক ব্যবস্থাকে সাজাবে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এতে বেসামরিক ক্ষমতার জায়গা আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের সহসভাপতি ও সাংবাদিক মুনিজায়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সামরিক ও বেসামরিক সম্পর্কের ভারসাম্য নেই। যেখানে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল, সেখানে বরং তাদের আরও ক্ষমতাশালী করা হয়েছে।’
আদালতসংক্রান্ত পরিবর্তন নিয়ে তীব্র উদ্বেগ
সংশোধনীর দ্বিতীয় বড় বিতর্ক আদালত ও বিচারব্যবস্থাকে ঘিরে। নতুন ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট (এফসিসি) গঠন করা হবে, যার বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানব্যাখ্যাসংক্রান্ত মামলাগুলো এখানেই নিষ্পত্তি হবে।
মুনিজায়ে জাহাঙ্গীরের মতে, ‘এটি ন্যায্য বিচারের অধিকারকে মূলত পাল্টে দিচ্ছে। বিচারক নিয়োগ ও বেঞ্চ গঠনে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব আরও বেড়ে গেল।’ সাংবাদিক আরিফা নূর বলেন, ‘এখন বিচারব্যবস্থা কার্যত নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ হয়ে পড়বে। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ কমে যাবে।’
আগে এসব সংবিধানিক মামলা শুনত সুপ্রিম কোর্ট। কেউ কেউ বলছেন, এতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার জট তৈরি হচ্ছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, এই যুক্তি ভুয়া; বাকি আদালতগুলোর মামলার ভারই সবচেয়ে বেশি।
আইন পাসের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি পদত্যাগ করেন। বিচারপতি আথার মিনাল্লাহ লেখেন, ‘যে সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছিলাম—তা আর অবশিষ্ট নেই।’ বিচারপতি মনসুর আলী শাহ বলেন, সংশোধনী আদালতকে সরকার–নিয়ন্ত্রিত করে ফেলেছে।
এবার থেকে বিচারকদের মতামত ছাড়াই অন্য আদালতে বদলি করা যাবে। আপত্তি জানালে বিচার কমিশন তা খতিয়ে দেখবে; কমিশন অগ্রাহ্য করলে বিচারককে বাধ্য হয়ে অবসর নিতে হবে। সমালোচকদের আশঙ্কা, এটি বিচারকদের ওপর চাপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
আইনজীবী আহমেদ বলেন, ‘একজন বিচারককে নিজের প্রদেশ থেকে সরিয়ে অন্য আদালতে পাঠানো হলে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আরও সংকোচ বোধ করবেন।’ তাঁর মতে, এতে পাকিস্তানের ক্ষমতার ভারসাম্য আরও নড়বড়ে হবে।
মাইকেল কুগেলম্যানও সাবধান করেছেন, ‘অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ চেপে রাখা—সমাজের স্থিতির জন্য শুভ নয়।’ সাংবাদিক নূর মনে করেন, গত বছরের ২৬তম সংশোধনীসহ ধারাবাহিক পরিবর্তন পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী পথে নিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ২৮তম সংশোধনীর গুঞ্জনও রয়েছে।
সব মিলিয়ে, সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানে ক্ষমতার পাল্লা এখন আরও বেশি সেনাবাহিনীর পক্ষে ভারী হয়ে উঠেছে—এটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র: বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



