আসহাবিল ইয়ামিন : শিরোনাম পড়ে কিছুটা গল্পের মতো মনে হতে পারে। মাত্র ১৫ বছর বয়সী কিশোর নিজের ঘরের কম্পিউটারে বসে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাসহ বিভিন্ন সংস্থার কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক করে ফেলে। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি। এই কিশোরের কৌতূহল ও প্রতিভা নাসার সুরক্ষাব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল। ঘটনাটি সারা বিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। কীভাবে এক কিশোর এত কম বয়সে এত উন্নত হ্যাকিং–জ্ঞান অর্জন করল? নাসার সুরক্ষাব্যবস্থায় আসলেই কি এত ফাঁকফোকর ছিল?
১৯৯৯ সালের জুলাইয়ের একদিন। নাসার নিরাপত্তাবিশ্লেষকেরা তাঁদের সিস্টেমে এক অস্বাভাবিক কার্যকলাপ খেয়াল করেন। আক্রমণের ক্ষতির মাত্রা নির্ণয় ও সিস্টেম সুরক্ষিত করার জন্য ২১ দিন ধরে সব কার্যক্রম বন্ধ রাখে নাসা, যার ফলে তাদের প্রায় ৪১ হাজার ডলার ক্ষতি হয়। এ সবকিছুর পেছনে ছিল ১৫ বছর বয়সী কিশোর—জোনাথন জেমস!
১৯৮৩ সালে দক্ষিণ ফ্লোরিডায় জন্মগ্রহণ করেন জোনাথন জোসেফ জেমস। তাঁর বাবা রবার্ট জেমস একজন প্রোগ্রামার ছিলেন। বাবার পেশার প্রভাবে জোনাথন ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আমেরিকা যখন ইন্টারনেটের জগতে নতুন নতুন আবিষ্কার সংযোজন করছিল, তখন জোনাথন বাবার কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রোগ্রামিং আর নেটওয়ার্কিংয়ে দক্ষ করে তুলছিলেন। অন্যরা যেখানে ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াতেন, সেখানে জোনাথন কম্পিউটারের ভাষা বুঝতেন আর নেটওয়ার্কের গোপন রহস্য খুঁজে বের করতে ভালোবাসতেন।
তাঁর পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, জোনাথনকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু জোনাথন এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন না, বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তিনি বলেন, যদি তাঁকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, তবে ফিরে আসবেন আর ভালো ফলাফল করবেন।
জোনাথনের বয়স যখন মাত্র ছয় বছর। তখন তিনি কম্পিউটারের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলতেন। এমনকি তাঁর মা–বাবাও তাঁর এই আসক্তি ও আগ্রহ দেখে অবাক ও চিন্তিত হতেন। তাঁর বাবা ছেলের গেম খেলা কমাতে কিছু সফটওয়্যার ইনস্টল করেন কম্পিউটারে। জোনাথন এই সফটওয়্যারের কাজ কীভাবে যেন বন্ধ করে ফেলতেন। এর কিছুদিন পর জোনাথন সি প্রোগ্রামিং শেখেন। একদিন অফিস থেকে ফিরে জোনাথনের বাবা অবাক হয়ে দেখলেন, জোনাথন কম্পিউটার থেকে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম সরিয়ে লিন্যাক্স ইনস্টল করেছেন। জোনাথন লিন্যাক্স অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে জানতেন এই কাজ করে।
জোনাথনের বয়স যখন ১৩ বছর, তখন তাঁর কম্পিউটারের প্রতি বেশি আসক্তির কারণে পড়াশোনা খারাপ হয়ে যায়। এ কারণে তাঁর পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, জোনাথনকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু জোনাথন এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন না, বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তিনি বলেন, যদি তাঁকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, তবে ফিরে আসবেন আর ভালো ফলাফল করবেন। কথা রাখতে তিনি হ্যাক করেন নিজের স্কুলের কম্পিউটার সিস্টেম। এর মধ্য দিয়েই তিনি হ্যাকিংয়ের দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। এই দুনিয়ায় পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘C0mrade’ নামে। এর পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন হ্যাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
শুরুতে তিনি ছোট ছোট সিস্টেম হ্যাক করেন। কিছুদিনের মধ্যে এটিতে আর আগ্রহ পান না তিনি, চেষ্টা করতে থাকেন বড় কিছু করার। ১৯৯৯ সালের ২৯ জুন রাত। জোনাথন আলাবামার হান্টসভিলে একটি দুর্বল সার্ভার খুঁজে পান। সেই সার্ভারে ম্যালওয়্যার ইনস্টল করে মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ১৩টি কম্পিউটারে ঢুকে পড়েন। এটি ছিল নাসার একটি বিভাগ। এই সেন্টারে উন্নত রকেট ইঞ্জিন তৈরি করা হতো। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) জন্য কাজ করত।
খুঁজতে খুঁজতে জোনাথন নাসার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারে ঢুকে পড়েন। এই সফটওয়্যার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করত। নাসার বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সফটওয়্যারের দাম ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু জোনাথন বলেন, এই সফটওয়্যারের কোনো মূল্য নেই, কারণ এটি ঠিকমতো কাজ করে না। তাঁর মতে, তিনি শুধু এই সফটওয়্যারের কোড দেখতে ও শিখতে এখানে প্রবেশ করেছিলেন।
নাসার সার্ভারে হ্যাক করার পর নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞরা এই ঘটনা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। তাঁরা সার্ভারটি ২১ দিনের জন্য বন্ধ রাখেন। এফবিআই এটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। জোনাথন ১৯৯৯ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সির (ডিটিআরএ) মতো আরও অনেক সরকারি সংস্থার কম্পিউটার হ্যাক করেছিলেন। তিনি পেন্টাগনের মেইলবক্স থেকে ৩ হাজার ৩০০টি ই–মেইল ডাউনলোড করেন। এফবিআই জোনাথনের হ্যাকিংকে ভাবে, এটি হয়তো কোনো হ্যাকিং সংস্থা করছে।
২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি। হ্যাকার ধরা পড়ে। জোনাথনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। জোনাথনকে নিজেদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে স্পেশাল ফোর্স। তাঁর বাড়ি থেকে পাওয়া যায় চারটি কম্পিউটার, একটি ল্যাপটপ ও একটি পকেট কম্পিউটার। জোনাথন অপরাধ স্বীকার করেন। জোনাথনের কাজের কারণে তিনি ১০ বছরের জন্য কারাগারে যেতে পারতেন। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাঁকে ছয় মাসের জন্য হাউজ অ্যারেস্ট বা বাড়িতে বন্দী থাকতে হয়। সঙ্গে তাঁর কম্পিউটার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া তাঁর অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখে স্বীকারোক্তি জানাতে হয়।
সূত্র: ব্ল্যাক হ্যাট এথিক্যাল হ্যাকার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।