আমি তখন ঢাকা কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। সময়টা ১৯৭৭ সাল। দেশের ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। সামরিক শাসক থেকে রেফারেন্ডাম করে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
বিরোধীদের হয় তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছেন অথবা বন্দি করে রেখেছেন। রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন তিনি। দেশের সবকিছু তাঁর একচ্ছত্র কঠোর নিয়ন্ত্রণে। পান থেকে চুন খসলেই বিপদের সম্ভাবনা।
এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একটি আকস্মিক ঘটনা ঘটলো। তখনো ঢাকার কুর্মিটোলায় নতুন বিমান বন্দরটি চালু হয়নি। তেজগাঁ বিমান বন্দরেই সব প্লেন ওঠানামা করতো। আমরা আমাদের তেজগাঁর বাসার ছাদ থেকে প্লেনের উঠানামা দেখতে পেতাম।
হঠাৎ একদিন শুনি জাপান এয়ার লাইনসের একটি প্লেন হাইজ্যাক করে তেজগাঁও বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রথমে কথাটা বিশ্বাস হলো না। কিন্তু টিভি খুলে দেখি হুলুস্থুল কাণ্ড। ঘটনা সত্যি। জাপান এয়ার লাইনসের প্লেনটি প্যারিস থেকে টোকিও যাচ্ছিলো।
পথিমধ্যে ইন্ডিয়ার আকাশসীমায় প্লেনটি হাইজ্যাক হয়ে যায়। হাইজ্যাকাররা প্লেনটি নিয়ে এসেছে তেজগাঁও বিমান বন্দরে। পৃথিবীতে এতো জায়গা থাকতে প্লেনটাকে ঢাকায় নিয়ে আসার কি কারণ থাকতে পারে সেটা আমার বোধগম্য হলো না। জিয়াউর রহমানও হয়তো সেটাই ভাবছিলেন। বাড়তি ঝামেলা কার ভালো লাগে?
প্রান্তে আস্তে ছিনতাই নাটকের সাসপেন্স শুরু হলো। জানা গেলো হাইজ্যাকাররা জাপানের নিষিদ্ধ ঘোষিত রেড আর্মির সদস্য। রেড আর্মি একটি জঙ্গি সংগঠন। তাদের বেশ কিছু সদস্য জাপানের বিভিন্ন জেলে বন্দি হয়ে আছে। তাদের যুক্তির জন্য সহযোগীরা এই দুঃসাহসিক কাজটি করেছে।
বিমানে দেড়শোর মতো যাত্রী ছিলেন। যাত্রীদের মুক্তির বিনিময়ে ছিনতাইকারীরা মুক্তিপণ হিসাবে তাদের কয়েকজন সহযোদ্ধার মুক্তি দাবি করল। আর সেই সাথে দাবি করে বসলো নগদ ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দাবি পূরণ করার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিলো ছিনতাইকারীরা। এই সময়ের মধ্যে তাদের দাবি না মানলে তারা প্লেনটি যাত্রীসমেত বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার হুমকি দিলো। একেবারে হলিউডের সিনেমার মতো গল্প। উত্তেজনায় আমরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকলাম। তখন টিভি মানে সবেধন নীলমণি বিটিভি। একটাই সাদাকালো চ্যানেল।
তারা তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে লাইভ সম্প্রচার শুরু করলো। টিভির পর্দায়। বিমানটিকে দেখা যাচ্ছে। আর টিভি স্ক্রিনের উপর লেখা আছে ‘লাইভ’। এটার মানে যে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে সেটা তখন অনেকেই জানতো না। লাইভ লেখা দেখে আমাদের ভাড়াটিয়া মতিউর রহমান সাহেব বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, যাত্রীরা এখনো সবাই জীবিত আছে, তাই টিভিতে লাইভ লিখেছে।
ওনার কথা শুনে আমরা মুখ টিপে হাসলাম। বড়দের সাথে কি তর্ক করা যায়?
আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম পরবর্তী ঘটনা দেখার জন্য। আমাদের বাসা থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দর বেশিদূরে নয়। পরদিন সকালে আমি সাইকেল চালিয়ে গেলাম হাইজ্যাক করা প্লেন দেখতে। গিয়ে দেখি বিমান বন্দরের বাইরে বেশ ভিড়। লোকজন উকিঝুঁকি দিচ্ছে। কাছে যাবার উপায় নেই। বিমান বাহিনীর সশস্ত্র সৈন্যরা বিমানবন্দর পাহারা দিচ্ছে। তাই দূর থেকে হাইজ্যাক করা প্লেনের লেজ দেখেই বাড়ি ফিরলাম।
সন্ধ্যায় টিভির খবরে শুনলাম জাপান সরকার হাইজ্যাকারদের দাবি মেনে নিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তারা আরও একদিন সময় চেয়েছে তাদের দাবি পূরণ করতে। তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে হাইজ্যাকারদের সাথে আলোচনা করছিলেন তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদ। তিনি জাপান সরকারের পক্ষে আরও একদিন সময় চাইলেন। তারা রাজি হলো। এদিকে ভেতরে ভেতরে আরেকটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে সেটা বিমান বাহিনী প্রধান বুঝতে পারলেন না। তিনি ব্যস্ত রইলেন হাইজ্যাকার করা প্লেন নিয়ে।
যথাসময়ে জাপান থেকে বিশেষ বিমানে করে রেড আর্মির বন্দিদের নিয়ে আসা হলো। সাথে নগদ ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাতে বিমান বাহিনীর প্রধানের তত্ত্বাবধানে বন্দি বিনিময় শুরু হলো। টিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছে। হঠ্যাৎ করেই সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা বসে ভাবছি কি হলো। কিছুক্ষণ পর শুনলাম প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। আমাদের বাসার খুব কাছেই ছিলো বিমান বাহিনীর অফিসার্স কোয়ার্টার্স। গোলাগুলির শব্দ সেদিক থেকেই আসছিলো। সারারাত ধরে গোলাগুলি চলল। বুঝলাম ভয়াবহ একটা কিছু ঘটনা ঘটেছে।
পরদিন সব জানা গেলো। রাতে বিমান বাহিনীর কিছু সৈনিক বিদ্রোহ করেছে অফিসারদের বিরুদ্ধে। বিমান বাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা যখন বিমান ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত তখন রাতের অন্ধকারে বিদ্রোহ করেছে তারা। অফিসারদের উপর হামলা করেছে। তাদের সশস্ত্র আক্রমণে বিমান বাহিনীর দশ বারোজন সিনিয়র অফিসার নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। আহতদের মধ্যে বিমান বাহিনীর প্রধানও রয়েছেন। এই প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে ছিনতাইকারীরা প্লেন নিয়ে পালিয়ে গেছে। সাথে করে নিয়ে গেছে জাপান থেকে নিয়ে আসা তাদের সহযোদ্ধাদের আর সেইসাথে ছয় মিলিয়ন ডলার। যাবার আগে তারা অবশ্য বেশ কিছু জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিলো। তারাও জাপান থেকে আসা সেই বিশেষ বিমানে ফিরে গেছেন।
জিম্মি নাটকের অবসান হয়েছে ভয়ংকর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। বিমান বন্দর রক্তাক্ত হয়ে গেছে বিমান বাহিনীর অফিসারদের রক্তে। পরে শুনেছি আমাদের ঢাকা কলেজের একজন ছাত্র ও নিহত হয়েছিল ওই গোলাগুলিতে। তার বাবা ছিলেন বিমান বাহিনীর একজন অফিসার। ওদের বাসার ভেতর একটা গুলি এসে ওকে আঘাত করেছিল।
সরকারের অনুগত সেনাবাহিনীর সদস্যরা কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করছিলো। নিহত হলো অনেক বিমান সেনা। বন্দি হলো কয়েক হাজার। পরে শুনেছি সামরিক আইনে এদের অনেককেই সংক্ষিপ্ত বিচার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল অনেকের। অনেক নির্দোষ মানুষকেও সাজা দেয়া হয়েছিলো। সে এক করুণ ইতিহাস।
আমাদের দেশের ইতিহাসে এই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। এই ট্র্যাজিক ইতিহাস আমরা অনেকেই এখন ভুলে গেছি। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এটি একটি অজানা অধ্যায়। সূত্র : কালের কণ্ঠ
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী গবেষক ও লেখক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।