জুমবাংলা ডেস্ক : ক্লাসে আমার ডিনার ডিউটি পড়েছিল। নার্সারির ছেলেমেয়েরা খাবে এবং তাদের তদারক করতে হবে। হঠাত্ দেখি এক টেবিল থেকে একটি সাদা ছেলে সটান উঠে বলছে, ‘আমি এখানে বসে খাব না।’
আমি দৌড় দিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কারণ কী? কেন খাবে না?’
আবুল ওর মুখ খুলে খায় এবং খেতে খেতে কথা বলে। ‘আবুল ইজ ইটিং হিজ মাউথ ওপেন। অ্যান্ড টক উইথ মাউথফুল।’
সর্বনাশ, বাঙালি ছেলে! ওকে বাড়িতে তো ‘ইটিং ম্যানার্স’ শেখানো হয়নি। ওর বাবা খুব সাধারণ একজন। মা-ও তাই। কাজেই ‘ইটিং ম্যানার্স’ বলে যে ভয়াবহ একটি নিয়ম বিদেশে চালু আছে, আবুলকে তা শেখানো হয়নি। আজই ওর বাড়িতে গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বললাম, ‘কেউ খেতে খেতে কথা বলবে না।’
ক্লাস শেষ হলে আমি ওর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে রওনা দিই। বেশি দূরে নয়। বাড়িতে আবুলের মা, ছোট এক বোন এবং আবুল। মা আমাকে দেখে একেবারে হইচই শুরু করে দিলেন—‘আউকা মিস। বউকা। কী খাইতা মিস? হাতকড় দিয়া মাছ রান্না করছি, খাইতা নি আপা?’
বলি, ‘৪টার সময় আমি কখনো ভাত খাই না। তবে এই খাওয়াদাওয়া নিয়েই কথা বলতে আসা।’
আবুলের মা এরপর এক কাপ চা আর কতগুলো বিস্কুট সামনে ধরলেন। আমি আর কোনো প্রতিবাদ না করে চা পান করতে শুরু করি। সিলেটিরা খুব অতিথিপরায়ণ এবং এই অতিথিপরায়ণতার প্রধান কথাই খাওয়া। আমাদের কালচার। আমাকে নানা কাজে হোম ভিজিট করতে হয়েছে এবং ওদের খাওয়ানোর জন্য এই ব্যস্ততা লক্ষ করেছি। দু-এক জায়গায় বোয়াল মাছও খেয়েছি। কখনো মুরগি। তবে চা হলো কম্পালসারি। আস্তে করে বলি, ‘আমি তোমাকে কতগুলো কথা বলতে এসেছি। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে আবুল যখন দুপুরে ডিনার খায়, ও কিছু সমস্যা সৃষ্টি করে।’
‘কেমুন সমস্যা আপা। খুইলা কইতা। আমি তো অরে মুখে তুইলা খাওয়াইছি। তবে এখন স্কুলের ডিনারের জন্য নিজে নিজে খায়।’
‘সেখানেই সমস্যা।’
অনেক জিনিস এ দেশে আছে, যা আবুল জানে না। ফলে অন্য বাচ্চারা ওর সঙ্গে খেতে চায় না। এসব আমিও জানতাম না। তবে আমাকেও শিখতে হয়েছে। এরপর কাগজে যে লিস্টি বানিয়ে এনেছিলাম, তা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি।
১. মুখভর্তি খাবার নিয়ে কথা বলা যাবে না।
২. খাওয়ার সময় কোনো শব্দ নয়। হাপুসহুপুস, চাটুমচুটুম, সুরুত্-সরুত্—এমন সব শব্দ একেবারেই নিষেধ। মুখ বন্ধ করে খাবে, পুরোটা গেলার পর কথা বলতে পারে। তবে কথা না বলাই ভালো।
৩. কখনো কাঁটাচামুচ মুখে দেবে না। কেবল খাবার মুখে পুরতে যতটুকু দিতে হয়। খাওয়া হয়ে গেলে কাঁটাচামচ ও চাকু প্লেটে রেখে দেবে।
৪. মেইন খাওয়া হয়ে গেলে ডেজার্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্লেট তুলে নিয়ে অন্য পাত্রে ডেসার্ট দেওয়া হবে।
৫. কোনো কিছু চাটা চলবে না। প্লেট বা চামুচ বা চাকু। লিক করা নিষেধ।
৬. অন্যের খাওয়া দেখার দরকার নাই।
এমনিভাবে আমি তাকে যা যা জানার দরকার সব বলে আসি। ১০টি সোনালি নিয়ম। হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি, মুখে খাবার নিয়ে কথা বলতে গেলে মুখের খাবার দেখতে যে ভালো লাগে না, সেটাও খেয়ে দেখিয়ে দিই।
এই সব শেষ করে আর এক কাপ চা খেয়ে ফিরে আসি। এখন আর স্কুলে যাব না ঠিক করি। এখন বাড়িতে সোজা। ভাবছি, এ দেশের খাবারের ম্যানার্সের নানা সব নিয়মরীতি। আমরা হাত দিয়ে খাই। আর খেতে খেতে কত সব গল্প করি। চার বছরের আবুলকে কত কিছু জানতে হয়। এই খাবার ‘ম্যানার্সটা’ পালন না করলে একেবারে ভয়াবহ ব্যাপার।
এরপর ভালোই চলছিল সবকিছু। যারা খাবারের ম্যানার্স জানে না, তারাও শিখে ফেলে। তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। আমার এই ডিনার ডিউটি পর্ব ভালোমতোই চলতে থাকে। প্রথম ডিনারের প্রধান খাবারের পর মিষ্টি বা ফল দেওয়া হয়। বাচ্চারা এসব ব্যাপার খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে। যেমন—কথাও শেখে ওরা বড়দের চাইতে তাড়াতাড়ি। আমার ছেলেমেয়েও শিখেছিল।
একদিন হঠাত্ আবুলকে নিয়ে সমস্যা। প্রথমে বুঝতে পারিনি। মাইকেল সটান দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আমি ওর টেবিলে আর বসব না। ও কোনো ম্যানার্স জানে না।’ কী করল আবার আবুল? খোঁজ নিয়ে জানলাম, ব্রিটেনের খাবার টেবিলের অন্যতম প্রধান ম্যানার্স হলো কখনো এখানে খেতে এসে কেউ চুল ঠিক করতে পারবে না। মানে, খাওয়ার আগে পকেট থেকে চিরুনি বের করে কেউ চুল ঠিক করছে খাবার টেবিলে বসে, এটা সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। আবুলের নতুন শার্টের পকেটে একটি নতুন ছোট চিরুনি। চিরুনির রং গোলাপি। বুঝতে পারলাম, এই চিরুনি ওর খুবই প্রিয়। তাই ডিনার আসার আগেই পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল ঠিক করছে। ভাবলাম, আজ আবার ওর বাড়িতে যেতে হবে। সবচেয়ে ভয়ানক ম্যানার্সটি ও শেখেনি।
‘আউকা আফা, কী খাইতা কও।’
আবার ঘণ্টাখানেক থেকে ওর মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলি। তারপর আরও বলি, কখনো কাঁটাচামচ বা চাকু হাত ফসকে নিচে পড়ে গেলে তা তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে খাওয়া যাবে না। ও নয়, আর একজন এমন করেছিল।
১৮ বছর আগে আমি রিটায়ার করেছি। ছেলেপুলের সঙ্গে পথেঘাটে আর দেখা হয় না। অনেক আগে একজনকে দেখেছিলাম। ও একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমার বুকের ভেতরে ঠাঁই পেয়েছিল। সে আমার সব চাইতে সুন্দর অভিজ্ঞতা। একদিন ইস্টএন্ডে গিয়েছি। দেশে টাকা পাঠাব বলে। রাস্তা দিয়ে চলছি, হঠাত্—‘আফা নি! সালেহা আফা, কেমন আছেন গো আফা। কত দিন দেখি না।’ আমি চিনতে পারি—ও হলো আবুলের মা।
বয়স একটু বোঝা যায়, তার পরেও চিনতে আমার তেমন অসুবিধা হয় না। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। সঙ্গে একজন অত্যন্ত স্মার্ট সপ্রতিভ ছেলে আমাকে সালাম দেয়। এত চমত্কার স্মার্ট ছেলে আমাকে অভিভূত করে। প্রায় ১৮ বছর পরের কথা। আমি কী করে আবুলকে চিনব? যাকে আমি খাওয়ার ম্যানার্স শেখাতে বাড়িতে দুই বার গিয়েছিলাম।
‘আফা, চিনতো পারছুইন না? ও-ই তো আবুল।’
‘এই আবুল নাকি?’
চমত্কার দেখতে হয়েছে। আমার কথা ওর মনে থাকার কথা নয়। বলি, ‘আবুল, কী করো তুমি?’
পরিষ্কার বাংলায় আবুল বলে, ‘এবার অক্সফোর্ড থেকে মাস্টার্স করেছি মিস। বিনীত চমত্কার উত্তর, যাকে ইংরাজিতে বলে পোলাইট ইংরেজি।
আমি অভিভূত। এ দেশে জীবনের সবগুলো ম্যানার্স শিখে আজ ও অক্সফোর্ড থেকে ইংরেজিতে এমএ করেছে। একটু হাগ করে বলি, ‘আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ আবুল!’
এই ‘প্রাউড’ কোনো লোক দেখানো প্রাউড নয়, সত্যি সত্যিই আমার ভেজা চোখ বলছে আমি প্রাউড। সাধারণ আবুল আজ অসাধারণ।
কোথায় আছে সেই ছোট্ট দুষ্টটা, যে একদিন বলেছিল, ‘মিস, আমি তোমারে ভালো পাই। আমি বড় হইয়া তোমারে বিয়া করতাম।’
যে ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে কোলে ঘুমিয়ে পড়ত প্রথম স্কুলে আসার কারণে, সেই ছেলে, যার জুলাই মাসের ৭ তারিখে জন্ম থেকে জেনেছিলাম—নিউমারোলজিতে সাত-সাত-সাত মানে খুবই অসাধারণ কিছু করবে ও। ও কি অক্সফোর্ডে বা ক্যামব্রিজে গিয়েছে? না যাক। ভালো থাক জীবনে। আর সেই অভিযোগ করা মাইকেল এখন কী করছে! হয়তো স্কুল লিভ করে কোনো একটি সাধারণ কাজ! লেখক: ব্রিটেনপ্রবাসী কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।