জুমবাংলা ডেস্ক : চারদিকে অন্ধকার, নেই কোন যানবাহন। মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে এসে উঠতে হবে নৌকায়। এরপরে যেতে হবে গন্তব্যে। তবে খুব প্রয়োজন না হলে রাতে কেউ নদী পার হতেন না। আর দিনের বেলায় নদীর ওপার যেতেই হবে। নইতো অনেকের পেটে খাবার জুটবে না। কারো কারো আবার থেকে যাবে দিনের কাজ অসম্পন্ন। তারা অধিকাংশই নিম্নআয়ের মানুষ।
তাদের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে শুরু হয় ভোগান্তি। সংকট দেখা দেয় যানবাহনের। অনেক কষ্টে রোগীকে নিয়ে আসতে হয় নদীর ঘাটে। নৌকায় যেতে হয় ওপারে। পরে চিকিৎসকের কাছে ছুটে চলা। তবে বিকল্পও পথ ছিল। সেই পথে যেতে এর চাইতে আরো অনেক বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের।
১৭ বছর আগে নিত্যদিনের এমন চিত্র ছিল বগুড়ার দক্ষিণ বেজোড়া গ্রামের। এখন একটি সেতুই বদলে দিয়েছে তাদের জীবন ও জীবিকা। গ্রামে ঘটেছে অকল্পনীয় পরিবর্তন। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। একইসঙ্গে সামাজিক পরিবেশ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই স্বাবলম্বী। অথচ ১৭ বছর আগে ওই গ্রামের ৮০ শতাংশ মানুষই ছিলেন অর্থনৈতিক সংকটে। সেখানে এখন আছে পিচঢালা সড়ক। নেই যানবাহন সংকটও।
শনিবার রাতে ওই গ্রামের তালতলা বন্দরে গিয়ে দেখা গেছে চায়ের দোকানগুলোতে আড্ডা চলছে। তারা গল্পে মশগুল হয়ে আছেন। অনেকে আবার দোকানে বসে দেখছেন টেলিভিশন। গভীর রাত পর্যন্ত ওই বন্দরে লোকজনের আনাগোনা থাকেই। বাড়ি থেকে বের হলেই গ্রামের মানুষেরা চাল, ডাল ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাচ্ছেন হাতের নাগালে।
গ্রামটির একমাত্র বন্দর তালতলা। ওই বন্দরে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যই পাওয়া যায়। যা সম্ভব হয়েছে বনানী ব্রিজ নির্মাণের পর। ২০০৫ সালে করতোয়া নদীর ওপর এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়।
তালতলা বন্দরে কথা হয় আরিফুল ইসলাম আরিফের সঙ্গে। তিনি দক্ষিণ বেজোড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি জানান, বনানী ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার পরে গ্রামের বাসিন্দাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এক সময় গ্রামের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন নিম্নআয়ের। তারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিদিন নৌকায় উঠে নদী পার হয়ে কাজে যেতেন তারা। এছাড়াও অনেকে বগুড়া শহরের বিভিন্ন দোকানে কর্মচারী ছিলেন। তাদের সন্তানরাও ছিল না স্কুলমুখী। গ্রামে ২০ শতাংশ পরিবার ছিল স্বচ্ছল। সেই সব পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করত। বাকিরা পড়াশোনার বদলে জড়িয়ে পড়ে কৃষিকাজে।
তিনি আরো জানান, সেতু নির্মাণের পরে অনেকে গ্রামে রিকশা-ভ্যান চালাতে শুরু করেন। তবে এই যানবাহনগুলো তারা প্রথমদিকে ভাড়ায় চালালেও পরবর্তীতে হন মালিক। প্রতিদিনের উপার্জনের টাকা থেকে কিছু সঞ্চয় করে রিকশা-ভ্যান কেনেন তারা। শুধু তাই নয়, সেতু নির্মাণের পর গ্রামের কৃষকেরা জমিতে ফসল উৎপাদনে বেশি মনযোগী হয়ে পড়েন। কারণ সেতু নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। ফলে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে উৎপাদিত ফসল তারা বিক্রি করা শুরু করেন। এর আগে, জমি ফেলে রেখে তাদের অনেকেই দিনমজুরের কাজ করতেন।
আরিফুল ইসলাম জানান, সেতু নির্মাণের আগে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মাটি অথবা টিন দিয়ে তৈরি করা বাড়ি ছিল। জমির দামও ছিল না তেমন। কিন্তু এখন গ্রামে একতলা থেকে শুরু করে দুইতলা পর্যন্ত ইটের তৈরি বাড়ি আছে। একইসঙ্গে বেড়েছে গ্রামের জমির দামও। শুধু তাই নয়, গ্রামটির অধিকাংশই বাড়িঘর এখন আধাপাকা। এখন আর গ্রামে নেই মাটির বাড়ি। হাতেগোনা কয়েকটি টিন দিয়ে তৈরি বাড়ি থাকলেও তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল।
দুলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেনসহ অন্তত ১৫ জন গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, বনানী ব্রিজ নির্মাণের পর থেকেই গ্রামে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে নদীর ওপার বনানী বন্দর অথবা শহরের সাতমাথা এলাকায় যেতে হত। এখন গ্রামেই সবই পাওয়া যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত।
দক্ষিণ বেজোড়া গ্রামের একজন বাসিন্দা সাজেদুর রহমান সবুজ। তিনি সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সংগঠনের বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলা শাখার সভাপতি। কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, করতোয়া নদীর ওপর বনানী ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার আগে দক্ষিণ বেজোড়া গ্রামের মানুষদের অনেক দুর্ভোগ ছিল। যেমন একজন মানুষ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিতে হলে আগে নদী পার হয়ে তাকে হাসপাতাল নিতে হত। অথবা বিকল্প পথ ব্যবহার করতে হত। বিকল্প রাস্তায় হেঁটে অনেক পথ পাড়ি দেওয়া লাগত। সেই পথে আরো বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হত। তারপর পাওয়া যেত যানবাহন। আগে গ্রামে অ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি গ্রামে প্রবেশ করতে পারত না। ব্রিজ হওয়ার পরে যানবাহনের দুর্ভোগ থেকে আমরা রেহাই পেয়েছি।
তিনি আরো বলেন, গ্রামটির সামাজিক পরিবেশ আগে ছিল একেবারে নিম্নমানের। ব্রিজ হওয়ায় গ্রামে অনেক শিক্ষিত মানুষের নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। একইসঙ্গে সামাজিক পরিবেশ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেছে এবং বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন গ্রামের বাসিন্দারা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।