বুলবুল রেজা : রাতের বেলা কেনা গাভি দিনের বেলা হয়ে যাচ্ছে দেশি ষাঁড়! কম দামে গাভি কিনে তা বেশি দামে ষাঁড়ের মাংস হিসেবে ভোক্তাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন কসাইরা। আর এভাবেই চলছে রাজধানীর মাংসের বাজার। গরুর দালাল, ব্যাপারী এবং মহাজন অর্থাৎ কসাইদের সঙ্গে কথা বলেই এই প্রতিবেদক জেনেছে এসব তথ্য। যদিও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বলছে, সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে নেয়া হবে ব্যবস্থা।
রাজধানীর গাবতলী পশুর হাটে কোরবানির ঈদ ছাড়া সাধারণ সময়ে যেসব গরু বিক্রি হয় তার বেশিরভাগ ক্রেতাই কসাই। অর্থাৎ, এই হাট থেকে গরু কিনে জবাই করে বিক্রি করেন রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে।
গাবতলীর পশুর হাটে প্রতি রাতে যেসব কসাই আসেন তারা মূলত কী ধরনের পশু কেনেন, এর মধ্যে সবই কি ষাঁড়, নাকি গাভিও আছে, মহিষের সংখ্যাই বা কেমন? এই প্রতিবেদকের কাছে তথ্য আছে রাজধানীর বিভিন্ন মাংসের দোকানে প্রতিদিন ষাঁড় গরুর মাংস হিসেবে যা বিক্রি করা হয় তার বেশিরভাগই গাভির মাংস!
এই তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে গাবতলীর পশুর হাটে কয়েকজন গরুর দালাল এবং ব্যাপারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, কসাইরা সাধারণত দুইটি ষাঁড় গরু কিনলে গাভি কেনেন চারটি। যে ষাঁড়ের দাম দুই লাখ টাকা, ঠিক একই ওজনের গাভি পাওয়া যায় ৫০ হাজার টাকা কমে।
ব্যাপারীরা জানান, সব কসাই ষাঁড়ের সঙ্গে গাভি কেনে। ২০টার মধ্যে ষাঁড় জবাই করে ৬টা, বাকি সব গাভি! এরপর তারা ষাঁড়ের মাংসের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করে। যা সারা দেশেই হয়।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, চামড়া ছাড়ানোর পর বুঝার উপায় থাকে না কোনটা ষাঁড় আর কোনটা গাভি। তখন সব ষাঁড় হয়ে যায়। কিন্তু কোন দোকানে যদি কেউ গাভির মাংস কিনতে চায়, বলবে যে তারা গাভির মাংস বিক্রি করে না। সব ষাঁড় গরু। কিন্তু যদি দেড়শ গরু থাকে তাহলে ষাঁড় আছে ৫০টা, ১০০ আছে গাভি।
এক ব্যাপারী বলেন, ‘পাঁচটা যদি গাই গরু কাটে তাইলে একটা ষাঁড় গরু কাটবো। একটা ষাঁড় গরুর রান ঝুলাইয়া রাখবো সারাদিন। এডিতে লাভ হয় বেশি।’
দালাল আর ব্যাপারীদের তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে এবার কসাইদের অনুসরণ করতে চায় এই প্রতিবেদক। এরমধ্যে হাটে আসা জুরাইনের কয়েকজন কসাই পাওয়া গেলো। তারা একের পর এক গাভি কিনছেন। কথা বলে মিললো সত্যতাও। জানা গেলো পরদিন সকালে জুরাইন বাজারে জবাই হবে এসব গাভি। এরই মধ্যে ঢাকার চকবাজার, যাত্রাবাড়ী, মৌলভীবাজার, শনির আখড়ার কসাইরাও গরু কিনে তাদের গন্তব্যে রওয়ানা হয়েছেন, যার বেশিরভাগই গাভি।
গরুবোঝাই ট্রাকটির গন্তব্য রাজধানীর জুরাইন এলাকা। এই প্রতিবেদকও ট্রাকটিকে অনুসরণ করতে থাকে। দেখতে চায় শেষ পর্যন্ত এই মহিষ এবং গাভিগুলো কীভাবে ষাঁড়ে পরিণত হয়।
ভোর পাঁচটা ২০মিনিটে জুরাইন বাজারে ট্রাকটি আনলোড করা হয়। গাভিগুলো বাজারের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে রাখা হয় ষাঁড়গুলো।
পরদিন মানে ২৪ তারিখ সকাল সাড়ে সাতটায় এই প্রতিবেদক এবার হাজির ওই বাজারে। ততক্ষণে বেশিরভাগ গরু জবাই কাজ শেষ। দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা ষাঁড়, কোনটা গাভি। তখনও বাজারের ভেতরে কয়েকটি গাভি দেখা গেলো। উপায় না দেখে তাদের সহজ স্বীকারোক্তি তারা কখনও কখনও গাভি জবাই করেন।
কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেলো কোথাও বিক্রি হচ্ছে না গাভির মাংস। সবার দাবি দেশি ষাঁড়ের মাংস বিক্রি করছেন তারা। তাহলে এত গাভি গেলো কোথায়?
একপর্যায়ে গাভি কেনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলে দোকানিদের একাংশ স্বীকার করলেন, গাভীর মাংস ষাঁড় হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় অধিকাংশ দোকানে। তাদের মতে, ক্রেতারা জানে না কোনটা কিসের মাংস, ফলে গাভিকে ষাঁড় হিসেবে চালানো হচ্ছে।
এরমধ্যে এক ব্যবসায়ী তো একধাপ এগিয়ে বললেন, দোকানদার কাস্টমার না ঠকাইলে ব্যবসা টিকবে না। মিথ্যা কথা কইয়া লাভ নাই যে দোকানদার সব হাজি সাব! একটা ষাঁড়ের দাম যদি হয় এক লাখ টাকা, একই ওজনের একটা গাই গরুর দাম হইব ৮৫ হাজার টাকা। এইখানেই ১৫ হাজার টাকা কম। কাস্টমার দেখতাছে সামনে ষাঁড়ের রান ঝুলতাছে, পেছনে পাঁচটা গাই গরুর মাংস বেঁচতাছে। কেউ বুঝব না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলছেন, এটি সম্পূর্ণভাবে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা। এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমন অবস্থায় অতিলোভী মানসিকতা আর বাজার ব্যবস্থাপনাকে দুষলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক। তার মতে, সমাজের সবখানে অধঃপতন থাকবে, নৈতিক স্খলন থাকবে। আর মাংস ব্যবসায়ীরা নৈতিকতার পরিচয় দেবে — এতোটা সরল বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে না।
ভেড়ার মাংস খাসির মাংস হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে ভোক্তাকে। বাজার ব্যবস্থাপনায় চলছে এক ধরনের নৈরাজ্য, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।