ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : ভয় পেয়ো না, মনে রেখ পৃথিবীটা অনেক বড়। তোমাকে প্রয়োজন শেষে কেউ যদি ছুড়ে ফেলে, তবে সব শেষ হয়ে গেছে বলে থেমে যেও না। এ পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও তোমার জায়গা হবেই। হাল ছেড়ো না, নিজেকে এতটা অসহায় ভেবো না, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই ঘুরে দাঁড়ানো যায়। পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তোমাকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করতে পারে, সে পথে পা না বাড়ানোই ভালো।
কে যেন লিখেছিল, ‘তোমার সিভিটা আমাকে দিও, দেখি কী করতে পারি-বেকারত্বের সবচেয়ে বড় মিথ্যা আশ্বাস ও বড় উপহাস এটি।’ চরম সত্য হলো, সব মানুষ বিশ্বাসের মূল্য দিতে জানে না। এ পৃথিবীতে নিজের জায়গা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। খুব সহজে এটা হয় না। নিজের সঙ্গে নিজেকে লড়তে হয়, ঘাত-প্রতিঘাত সইতে হয়, প্রতিদিন নতুন করে মানুষকে চিনতে হয়, ভাঙা কাচের টুকরার ওপর পা ফেলতে ফেলতে রক্তের লাল চিহ্ন পথের উপর এঁকে কঠিন সময়কে অতিক্রম করতে হয়। লড়ার নামই তো জীবন, জন্ম থেকে জ্বলার নামই তো বাস্তবতা।
কখনো থেমে যাওয়া চলবে না। হয়তো কখনো কখনো এক পা, দু’পা করে পেছাতে হয়, সবার পেছনে সন্তর্পণে দাঁড়াতে হয়, সে পেছানোটা হেরে যাওয়া নয় বরং নিজেকে আরও অনেক বেশি এগিয়ে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় নেওয়া। নিজেকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য অনেক বেশি শক্তি দিয়ে গড়ে তোলা।
মাটির প্রতি বিশ্বাস রেখো, যে মাটিতে পা ফেলে মানুষ অসম্মান করে, সে মাটি মানুষের জন্য ত্যাগ করে। মানুষের খাদ্য, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করে। মাটির কাছ থেকে শিক্ষা নাও, নিজেকে মাটির মতো গড়ে তোলো। মানুষ বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, যে মাটিতে মানুষ একদিন মিলিয়ে যাবে; সে মাটি কখনো বিশ্বাসঘাতক হয় না। মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের নাড়ির টান থাকে, মাটির সঙ্গেও মানুষের নাড়ির টান থাকে। জন্মের সময়টাতে মায়ের সঙ্গে, মৃত্যুর সময় মাটির সঙ্গে। মাটি কখনো মানুষকে ফেলে দেয় না বরং মাটি ওপরে মানুষের জায়গা গড়ে দেয়।
যদি তুমি তোমার আত্মবিশ্বাসকে ধরে রাখতে পারো, তুমি যদি তোমার স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখতে পারো, যদি পথে চলতে চলতে আরও অনেক নতুন নতুন পথ তৈরি করতে পারো, হয়তো তোমাকে যেখান থেকে একদিন ছুড়ে ফেলা হয়েছিল, সেখান থেকেই তোমার রাজকীয় উত্থান হবে। তোমাকে এমন করেই ভাবতে হবে, কারণ তোমার বিশ্বজয়ের অপেক্ষাতেই হয়তো পৃথিবী বসে আছে, ইতিহাস অপেক্ষা করছে।
২.
স্বপ্ন দেখতে শেখো, স্বপ্নকে নিজের ভেতরে অনুভব করতে শেখো, কারও মতো করে নয়; নিজের মতো করে। স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে, একটা ভালো মন লাগে। সাহস আর মন অনেকের একসঙ্গে থাকে না, অনেক সময় সেটি সমান্তরাল রেললাইনের মতো থাকে। হয়তো তোমার দুটোই আছে কিন্তু সেটি কখনো পরখ করে দেখোনি। একবার পরখ করে দেখলে বোধহয় মন্দ হবে না, ভালোই হবে। সবাই চাইবে তাদের স্বপ্নগুলো তুমি পূরণ করবে, হয়তো তুমি সে স্বপ্নগুলো পূরণও করলে; অথচ কঠিন সত্য হলো, সে স্বপ্নগুলো তোমার নিজের ছিল না। সে স্বপ্নগুলো দিয়ে হয়তো তুমি অনেক বড় হলে; কিন্তু তুমি যা হতে চেয়েছিলে তা হতে পারলে না। সারা জীবন অন্যের চাপিয়ে দেওয়া স্বপ্নকে তোমার বয়ে বেড়াতে হবে। হয়তো ভেতরে ভেতরে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ না হওয়ার অতৃপ্তিটা তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে, তারপরও হাসি মুখে তুমি বলবে, যা হওয়ার সেটা ভালোই হয়েছে। হয়তো এটা তোমার মনের কথা না, অভিমানের কথা।
হয়তো তোমার মধ্যে লিওনার্দো-দ্য-ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো, জয়নুল আবেদিনের মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ছিল, হয়তো আইনস্টাইন, টমাস আলভা এডিসন, আইজাক নিউটন, এ পি জে আবদুল কালামের মতো বিজ্ঞানী ছিল, হয়তো পেলে, মারাদোনা, মেসি, রোনালদো, নেইমারের মতো ফুটবল খেলোয়াড় ছিল, হয়তো ব্রায়ান লারা, শচিন টেন্ডুলকার, সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার ছিল, হয়তো মার্ক টোয়েন, শেকসপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো লেখক ছিল, হয়তো জ্যাকমা, বিল গেটস, ইলন মাস্কের মতো উদ্যোক্তা ছিল, হয়তো সমারফিল্ড, জগদীশ চন্দ্র বসু, আবদুল্লাহ আবু সাঈদের মতো বিখ্যাত শিক্ষক ছিল, হয়তো সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটলের মতো দার্শনিক ছিল। এমন আরও অনেক সৃজনশীল মানুষ হয়তো তোমার ভেতরে জন্ম নিয়েছিল; কিন্তু তোমার স্বপ্নগুলো তুমি তোমার মতো করে দেখতে পারোনি বলে কিংবা তোমার স্বপ্নগুলো তোমার মতো করে দেখতে দেওয়া হয়নি বলে তুমি হয়তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় বড় প্রশাসকের চেয়ারগুলো পেয়েছ; কিন্তু ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানোর দুর্লভ সুযোগটা হারিয়েছ। হয়তো তোমার বাড়ি, গাড়ি, টাকা সব হয়েছে কিন্তু তোমার ভেতরের আসল মানুষটাই হারিয়ে গেছে।
আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে মা-বাবাসহ সমাজের সবাই সন্তানদের ভেতর জন্ম নেওয়া তাদের ইতিবাচক ও মৌলিক স্বপ্নগুলোর কখনো মূল্যায়ন করি না, তাদেরকে তাদের নিজেদের মতো করে স্বপ্ন দেখতে দেই না। স্বপ্নগুলোর নীরবে জন্ম হয়, নীরবে মৃত্যুও ঘটে। যদি নিজেদের স্বপ্নগুলো পাখির মতো আকাশে ডানা মেলে ওড়ার স্বাধীনতা পেত, তবে হয়তো সবার ঘরে ঘরে বিখ্যাত মানুষেরা জন্ম নিত। সবাইকে মনে রাখতে হবে, খাঁচায় বন্দি পাখি তার খাঁচাকেই পৃথিবী বলে মনে করে। মানুষটাকে চেনা দরকার, মানুষের ছায়াটাকে নয়।
৩.
পৃথিবী যে পথে চলছে, তুমি সে পথে চল না, তুমি তোমার পথ বদলে ফেল। পথ বদলাতে সাহস লাগে, আত্মবিশ্বাস লাগে, নিজেকে চিনতে হয়, যতই তুমি পথ বদলাতে বদলাতে নতুন পথে যাত্রা করবে, ততই পৃথিবীর মানুষ তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, তোমাকে একা করে ফেলবে, তোমাকে তাদের পক্ষে টানতে নিজের সব শক্তি প্রয়োগ করবে। কারণ, মানুষ নতুন পথকে ভয় পায়, পুরোনো পথ যতই আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে যাক না কেন, মানুষ পুরোনোকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়।
পথ বদলান মানে, সবাই যেভাবে চলছে সেভাবে চলা নয় বরং সবার যেভাবে চলা উচিত তেমন নতুন নতুন পথ সৃষ্টি করা। মাটিতে পা ফেললেই পথ তৈরি হয় না, চলার অনেক রাস্তা থাকে; তবে সে রাস্তায় যতই হাঁটা যায়, সে রাস্তা ততই ছোট হয়ে আসে। চেনা রাস্তা মানুষকে নতুন কিছু দেখাতে পারে না বরং চেনা রাস্তায় চলতে চলতে মানুষ নিজেই অচেনা হয়ে যায়। মানুষ তখন বুঝতে পারে না তার ভেতরে নতুনকে চেনার যে শক্তি ছিল, তার ক্রমাগত মৃত্যু ঘটছে। আত্মার মৃত্যু ঘটলে যেমন মানুষ মরে যায়, নিজেকে চিনতে না পারলেও তেমনি আত্মার মৃত্যু ঘটে। হয়তো তখনো দেহটা শরীরের চামড়াকে চাদর বানিয়ে মানুষের ভেতরের কঙ্কালটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়, তবে সেখানে যেটা থাকে, সেটা মানুষের মতো দেখতে হলেও মানুষ থাকে না।
মানুষ তখনই মানুষ হয়ে উঠতে পারে, যখন মানুষ তাকিয়ে দেখে তার চারপাশে অনেক রাস্তা আছে, তবে সে রাস্তা এতটাই চেনা যে, সেখান দিয়ে চলতে গেলে নিজের ভেতরের মানুষটাকেই হয়তো চেনা হয়ে উঠবে না কখনো। তখন যেখানে কোনো পথ নেই, সেখানে পা ফেলে ফেলে পথ তৈরি করে নিতে হয়। নতুন পথ তৈরি করতে পারলে নিজেকে পরখ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়, অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। যে স্বপ্ন মনে হচ্ছিল অধরায় থেকে যাবে, সে স্বপ্নকে পেরিয়ে আরেক নতুন স্বপ্নের পথে পা বাড়ানো যায়। এভাবে স্বপ্ন ভেঙে ভেঙে মাটিতে পা ফেলে ফেলে যেখানে কোনো পথ থাকে না, মানুষ যখন সেখানে পথ তৈরি করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন মানুষকে আর স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হয় না বরং স্বপ্ন মানুষের পেছনে পেছনে চলতে চলতে মানুষকে চেনায়, স্বপ্ন যতনা বড় তার চেয়েও বড় বাস্তবতা। স্বপ্নে রং থাকলেও বাস্তবতায় রং থাকে না, বরং সবাই যে মানুষটাকে কখনোই মানুষ বলে মেনে নেওয়ার মতো উদারতা দেখাতে পারেনি, সে মানুষটাই যে তাদের নতুন নতুন পথ দেখিয়েছে; সেটা স্বার্থপর মানুষ মুখে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করে।
যে মানুষটা পথ দেখায়, টুকরো টুকরো কাঁচের ওপর নরম পা ফেলতে ফেলতে রক্ত গড়িয়ে দিয়ে নতুন পথে পদচিহ্ন এঁকে দেয়, সে জানে পৃথিবী কখনো তার খোঁজ করবে না, তার মূল্যও দেবে না। তাতে কি? নিজেকে চিনতে পারাতে যে আনন্দ লুকিয়ে থাকে; সেটা অন্যের স্বীকৃতির জন্য কখনো কাঙাল হয় না। যে মানুষটা নতুন নতুন পথ সৃষ্টি করে সে জানে, তার এ সৃষ্টিকে কেড়ে নিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ নতুন নতুন ব্যবসার পথ খুঁজবে। তাতে কি? মানুষটা জানে তার মেরুদণ্ডটা সবসময় শক্ত থাকলে বরং তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করার খেলায় যারা মেতে উঠবে, হয় তারা হবে টিকটিকি কিংবা তেলাপোকার মতো মেরুদণ্ডহীন প্রাণী।
যারা সব জানে বলে ভুলের ভেতর ডুবে থাকে, অহংকার করে, তারা জানে না, যে আগুনের আবিষ্কার সারা পৃথিবীর জীবনধারাকেই পালটে ফেলেছে; সে আগুন প্রথম কে আবিষ্কার করেছে। তাজমহল তৈরির জন্য মুঘল সম্রাট শাহজাহানকে বাহবা দিলেও যে শ্রমিকরা সেটি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনে দিনে গড়ে তুলেছিল, তাদের নামগুলো বলতে পারে না। প্রায় ৫০০০ বছর আগে যে শ্রমিকরা পিরামিড গড়ে তুলেছিল, তাদের নাম যেমন কেউ জানে না, তেমনি জানে না পিরামিডের মতো বিস্ময়কর আবিষ্কারের পিছনে কাদের উন্নত বুদ্ধিমত্তা কাজ করেছিল। স্বার্থপর মানুষ উপভোগ করতে জানে, যারা এর পেছনে ছিল তাদের কথা কেউ মনে রাখে না।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।