লাইফস্টাইল ডেস্ক : আমি একটি পাউরুটি। আয়তাকার চারকোনা-বিশিষ্ট ৫০০ গ্রাম ওজনের এক ধরনের রুটি। শুধু রুটি বললে আমার আভিজাত্য ক্ষুণ্ন হয়। যদিও রুটি ও আমি সমগোত্রীয়। আমাদের জন্ম একই সূত্র থেকে। গম বা যবের আটা থেকে। অবশ্য ইদানীং রুটি তার সম্মান খুইয়েছে গমের সাথে ভুট্টা বা অন্য কিছু যৌগের মিশ্রণ থাকায়। এদিক থেকে আমি সৌভাগ্যবান। যৌগের মিশ্রণ না থাকায় আমার কদর এখনো অটুট। বলতে পারেন দিন দিন বাড়ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে বিভিন্ন দেশের রাজা-রানী, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সবার টেবিলেই আমার সদর্প অবস্থান। রাস্তার পাশের দোকান থেকে শুরু করে এক তারকা, দুই তারকা, তিন তারকা, চার তারকা, পাঁচ তারকা এবং আরো বেশি তারকাখচিত হোটেল-রেস্টুরেন্টে আমার একচ্ছত্র আধিপত্য। আমি না থাকলে তাদের তারকা মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। আতিথেয়তার মান ক্ষুণ্ন হয়।
সাধারণ স্যান্ডউইচ থেকে শুরু করে আমাকে যে কত হাজার খাবারের রেসিপি বানানো হয়েছে তার হিসাব কারোরই জানা নেই। আমি ছাড়া খাদ্যজগতে আর কাউকে নিয়ে এত রেসিপি বানানো হয়েছে তার হদিস কারো জানা সম্ভব নয়। সাধারণ রুটির সাথে আমার আর একটি পার্থক্য হলো- আমার যেখানে অবাধ যাতায়াত সেখানে রুটির প্রবেশাধিকার সীমিত। অপর দিকে, হোটেলের তারকা সংখ্যার সাথে সাথে আমার মূল্যমানও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আমার মর্যাদা।
যতক্ষণ আমি বেকারি, শোরুম বা চেইন শপের শোকেসে থাকি ততক্ষণ আমি বেশ ফুরফুরে থাকি; নিরাপদ থাকি। আমার শারীরিক অখণ্ডতা আমার নিরাপত্তার চাবিকাঠি। স্বাভাবিকভাবেই আমি আমার একক সত্তায় সগৌরবে অবস্থান করি আমার সমগোত্রীয়দের সাহচর্যে। সৃষ্টির আনন্দ এবং সৌন্দর্যে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। আমার একক শরীর আমাকে সাহস জোগায় প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য। আমার চতুর্দিকে খাদ্য লোলুপদের হিংস্র হায়েনার মতো চাহনি আমাকে বিচলিত করলেও আমার অবিভাজ্যতা আমাকে সাহস জোগায়। আমার আশপাশে থাকা সমগোত্রীয়রা সবাই একসাথে থাকায় তা একটি প্রতিরক্ষা-বলয়ের কাজ করে। এই বলয় আমাদের সবারই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আমাদের সবাইকে নির্ভার করে। এককভাবে আমরা দুর্বল হলেও আমাদের সম্মিলিত অবস্থান খাদকের সামনে লৌহ কঠিন প্রাচীরের মতো আমাদেরকে রক্ষা করে।
আমার সুস্বাদু অবয়ব ভোজনরসিককে আরো প্রলুব্ধ করে, ক্ষুধাতুর করে তোলে এবং সে আমাদেরকে আলাদা বা পৃথক সত্তায় সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। প্রায়ই সফল হয়। আমাকে দল বিচ্ছিন্ন করলেও আমি সাহস হারাই না। কারণ আমি একা হলেও আমাকে গোটা অবয়বে খাওয়ার ক্ষমতা অতি বড় খাদকেরও নেই। আমাকে খেতে হলে আমাকে টুকরো টুকরো করে বিভাজিত করতে হবে। কারণ বিভাজিত সত্তায় আমার কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না।
তখন আমি হয়ে পড়ি খাদকের হাতের পুতুল। খাদক এটি ভালো করেই জানে ও বুঝে। তাই প্রথম চেষ্টাতেই সে আমাকে টুকরো টুকরো করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। যেন আমাকে খাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে না পারি। একবার সফল হলেই আমার শরীরের টুকরো টুকরো অংশকে খাদক তার ইচ্ছেমতো রেসিপি বানিয়ে খাবারের টেবিলে সাজিয়ে, মহা আনন্দে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। যেভাবে খুশি আমাকে খাবার টেবিলে নিয়ে বিভিন্ন উপাচার সহযোগে তৃপ্তির সাথে খেতে থাকে। আমার বাধা দেয়ার, প্রতিরোধ করার কোনো শক্তি থাকে না। আমি খাদকের লালসার কাছে বিলীন হয়ে যাই। হারিয়ে যায় আমার পূর্ব পরিচয়। হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমি অনুভব করি অবিভাজ্য থাকার যৌক্তিকতা। টিকে থাকতে চাইলে অবিভাজ্যতা শক্ত হাতিয়ার। যত বড় খাদকই হোক না কেন, চোখ তুলে তাকাতে ভয় পায়। হাত গুটিয়ে নেয়। বারবার চিন্তা করে, ফন্দি আঁটে।
আমার বিভাজ্যতায় আমাকে উদরস্থ করতে তাকে কোনো কষ্ট করতে হয় না। বাধা দেয়ার, প্রতিরোধ করার কোনো শক্তি আমার আর থাকে না। অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ আমার জন্য অবশিষ্ট থাকে না। আমি খাদকের উদরে বিলীন হয়ে যাই। আমাকে উদরস্থ করে খাদক নিজেকে পুষ্ট করে। প্রাণশক্তি বাড়ায়। আর আমি আমার পূর্ব পরিচয় হারিয়ে অনুভব করি একত্রে থাকার গুরুত্ব। অবিভাজ্য থাকার যৌক্তিকতা। তখন মনে হয় ছোট ছোট সার্ডিন মাছ দল বেঁধে কিভাবে হাঙরের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে। কিন্তু আমার এই উপলব্ধি কোনো কাজে আসে না, কারণ আমি এখন বিলীন, পরিচয়হীন বর্জ্যমাত্র।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।