আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রায়ই খবরে দেখা যায়, নিলামে ব্যাগ বিক্রি হলো কোটি টাকায়। কিন্তু একটি সাধারণ ভ্যানিটি ব্যাগের দাম কোটি টাকা কী করে হয়? এটা কী রীতিমতো পশ্চিমা ধনীদের বাতুলতা নাকি আসলেই কোটি টাকার ব্যাগ কেনার মধ্যে কোনো যথার্থতা আছে; এসব নিয়ে একটি বিশেষ ব্যাগের ব্র্যান্ডের ওপর এই প্রতিবেদনে আলোকপাত করা হয়েছে।
হোক উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত অথবা একেবারে নিম্নবিত্ত; একজন নারীর আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, একটি ভ্যানিটি ব্যাগ অবশ্যই থাকবে। সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী একটি ভ্যানিটি ব্যাগের দাম দেড়শ টাকা থেকে শুরু হয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত সহনশীল। কিন্তু কী করে একটি ভ্যানিটি ব্যাগের দাম কোটি টাকার ওপরে হয় সেটি রীতিমতো ভাববার বিষয়।
কেইলি জেনার, কিম কার্দেশিয়ান, কার্ডি-বি কিংবা হলিউড-বলিউডের নামজাদা নায়িকাদের জীবন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। পাপ্পারাজিদের ক্যামেরাবন্দি তাদের ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন ভক্তরা। কী ঘড়ি পরলো, হাতে কোন মডেলের মোবাইল বা কোন ভ্যানিটি ব্যাগ ব্যবহার করেন- এসব বিষয়ে ভক্তদের আগ্রহ থাকে তুঙ্গে।
এদের মধ্যে হলিউডের নারী তারকাদের হাতে সবচেয়ে বেশি যে ব্রান্ড্যের ব্যাগ দেখা যায় সেটি হার্মিসের বার্কিন ভ্যানিটি ব্যাগ। ফ্রান্সের বিখ্যাত ফ্যাশন হাউজ হার্মিসের বার্কিন ক্যাটাগরির প্রায় প্রতিটি ফ্ল্যাগশিপ ব্যাগের দাম কোটি টাকার ওপরে। এদের মধ্যে বার্কিন-২০ ম্যাট অ্যালিগেটর ব্যাগটি চলতি বছর অক্টোবরে হংকংয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৭০ ডলারে বিক্রি হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখের মতো।
একটি ব্যাগের দাম ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা শুনে শুরুতেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার কথা। তবে কেন এই দাম আর একটি ভ্যানিটি ব্যাগের দাম কোটি টাকা হওয়ার পেছনে যুক্তি কী; এর জন্য জানতে হবে হার্মিসের বার্কিন ব্র্যান্ডের ব্যাগের ইতিহাস।
ব্রিটিশ অভিনেত্রী জেন বার্কিনের নাম অনুসারে এই ব্যাগের নামকরণ হয়েছে হার্মিস বার্কিন। ১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ এই অভিনেত্রী সেসময়কার হার্মিসের নির্বাহী প্রধান জেন-লুইস ডুমাসকে জানান, সদ্য মা হওয়ার পর একজন মায়ের জন্য উপযোগী এমন কোনো ফ্যাশনেবল ব্যাগ তিনি বাজারে খুঁজে পাচ্ছেন না। টুকিটাকি অনেক কিছু বহন করা যায় এমন ব্যাগ কিনতে গেলে সেটা আর ফ্যাশনেবল থাকছে না।
বার্কিনের এই অভিযোগ এবং হার্মিসের থেকে এমন ধরনের উপযোগী একটি ব্যাগ পাওয়ার প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে ডুমাস প্রথম বার্কিনের নামেই বাজারে আনেন হার্মিসের নতুন ব্র্যান্ডের এই ব্যাগ। বাজারে আনতে না আনতে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় হার্মিস। এরপর একের পর এক বাজারে নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর চাইলেই দোকানে গিয়ে কিংবা হার্মিসের শোরুমে গিয়ে এই জাতের ব্যাগ কিনতে পারবেন না ভোক্তারা। এরজন্য হয় নিলামে অংশ নিতে হবে আর না হলে আগে থেকে হার্মিসকে জানিয়ে নিজের মতো অর্ডার দিয়ে তৈরি করতে হবে বার্কিন ব্যাগ।
গত বছর হিমালয়ান বার্কিন নামে একটি ব্যাগ হার্মিস সাড়ে ৪ লাখ ডলারে বিক্রি করেছে; বাংলাদেশি মুদ্রায় যার দাম প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি এ ব্যাগটিতে রয়েছে ১৮ ক্যারেটের সাদা স্বর্ণের প্রলেপ আর ৫০টি হীরার টুকরা।
যতই হিরে-জহরতে মোড়ানো থাক, একটি ব্যাগের দাম কেন কোটি টাকা সেটি অনেকেই মানতে পারেন না। মূলত বিশ্বের সবচেয়ে দামী ব্র্যান্ড হার্মিসের ব্র্যান্ড ভ্যালু এবং সে প্রক্রিয়ায় ব্যাগগুলো তৈরি হয় আর যেসব উপকরণ থাকে ব্যাগে তাতে করে এটির দাম হয় কোটি টাকার ওপরে।
সম্প্রতি ফ্যাশন ম্যাগাজিন হোলার কন্ট্রিবিউটর শার্লি গোমেজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হার্মিসের বার্কিন ব্যাগের দাম এত বেশি হওয়ার প্রথম কারণ এর প্রক্রিয়া মাধ্যম। মূলত এক রকমের হাতে তৈরি এ ব্যাগগুলো কোনো মেকার বা আনাড়ি মানুষকে দিয়ে না, রীতিমতো শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় তৈরি করা হয়। যারা হার্মিসের ব্যাগ তৈরি করেন তাদের একেকজনের অভিজ্ঞতা কয়েক দশকের। এরা দিনের পর দিন পরিশ্রম করে হার্মিসের একটি ব্যাগ তৈরি করেন। হার্মিসের বার্কিন ব্র্যান্ডের ব্যাগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, কতটা সাধারণের মধ্যে নিখুঁতভাবে অসাধারণত্ব ফুটিয়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে।
এর বাইরে বার্কিন ব্রান্ডের প্রতিটি ব্যাগে ব্যবহার করা হয় উন্নত মানের চামড়া। যেনতেন চামড়া দিয়ে এই ব্যাগ তৈরি না করে এখানে ব্যবহৃত হয় মূল্যবান কুমির, বেজি, বিশেষ জাতের বাছুর এবং উটপাখির চামড়া। এদের একেকটি প্রাণীর চামড়ার ওপর নির্ভর করে ব্যাগের একেক রকমের স্থায়িত্ব।
হার্মিস প্রথমবারের মতো তাদের ব্যাগে বাছুরের চামড়ার টোগো লেদার ব্যবহার শুরু করে। বর্তমান বাজারে মাত্র দেড় মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের একটি টোগো লেদারের দাম ৩০ হাজার টাকারও বেশি। একইভাবে হার্মিসের ব্যাগে ক্লেমেন্স লেদার ব্যবহার করা হয়। এটিও বাছুরের চামড়া থেকে আসে। মূলত টোগো আর ক্লেমেন্সের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- টোগো লেদার আসে মাদি জাতের বাছুর থেকে আর ক্লেমেন্স লেদার তৈরি হয় মর্দা জাতের বাছুর থেকে।
মূলত ব্যাগে স্ফটিক ধাচের ডিজাইন করতে গেলে সেখানে স্থিতিস্থাপকতা এবং নমনীয়তা আনা এক রকমের অসম্ভব। কেবল টোগো এবং ক্লেমেন্স জাতের চামড়ায় একদিকে স্ফটিক ডিজাইন, অন্যদিকে স্থিতিস্থাপকতা ও নমনীয়তা দুটির মিশেল সম্ভব। এই দুই ধরণের লেদারের মধ্য মূল পার্থক্য হচ্ছে পুরুত্বে। যারা পাতলা ধাচের ভ্যানিটি ব্যাগ চান তারা হার্মিসকে অর্ডার দিয়ে টোগো লেদারের ব্যাগ কেনেন। আর মোটা ধাচের ব্যাগের জন্য আছে ক্লেমেন্স লেদার। এই দুই ধরণের লেদারই যেকোনো আবহাওয়া ও পানির সংস্পর্শে টিকে থাকতে সক্ষম।
এছাড়া ব্যাগের হাতল কিংবা পার্স জাতীয় শক্ত ব্যাগ তৈরি করতে হার্মিস ইপসম শ্রেণির চামড়া ব্যবহার করে। এ ধরণের চামড়া মোটা এবং শক্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে পার্স তৈরিতে হার্মিসের ইপসম লেদার ব্যবহারের প্রধান কারণ এটির পানি সহনশীলতা এবং এটির ধূলা-ময়লার সহ্যক্ষমতা। টোগো বা ক্লেমেন্সের মতো বর্তমান বাজারে মাত্র দেড় মিলিমিটার ইপসমের দামও ৩০ হাজার টাকার ওপরে।
হার্মিসের বার্কিন জাতের ব্যাগের ক্ষেত্রে এ ধরণের লেদারের ব্যবহার করা হয় ব্যাগের মূল কাঠামো তৈরিতে। ব্যাগের প্রলেপের জন্য ব্যবহার করা হয় কুমির, বেজি কিংবা উটপাখির চামড়া। এ ধরনের প্রাণির চামড়া ব্যবহারের মূল সুবিধা হচ্ছে ব্যাগে ব্যতিক্রমী একটি ধাচ আনা যা অন্যান্য ব্র্যান্ডে দেখা যায় না।
এরপর আসা যাক ডিজাইনে; হার্মিস সাধারণের মধ্যেও এমন কিছু ডিজাইন করে যা অন্য কোম্পানির ব্যাগে দেখা যায়না। বিশেষ করে বার্কিনের ভ্যানিটি ব্যাগ দেখে প্রথমেই যাতে ক্রেতার মনে হয়- এমন ডিজাইনের ব্যাগতো আগে দেখিনি; এ বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যাগ বানায় হার্মিস।
হার্মিসের ব্যাগের দাম বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ এর বিপণন নীতি। প্রতিষ্ঠানটি কখনও গণহারে ব্যাগ বানায় না। একদম হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাগ বানিয়ে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সেলিব্রেটি এবং ধনকুবেরা নিজেদের পছন্দমতো অর্ডার দিয়ে ব্যাপক অর্থের বিনিময়ে চাহিদামাকফিক ব্যাগ বুঝে নেয় হার্মিস থেকে।
অন্যদিকে হার্মিসের ব্যাগকে অনেকে ওয়াইনের সঙ্গে তুলনা করেন। রোলেক্সের ঘড়ি যেমনি কিনে রেখে অনেকে বেশি দামে বিক্রি করেন, তেমনি হার্মিসের ব্যাগও নিলামে কিনে পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রি করেন ক্রেতারা। এক্ষেত্রে অনেক বিনিয়োগকারী হার্মিসের ব্যাগ পরবর্তীতে উচ্চদামে বিক্রির উদ্দেশ্যে কিনে থাকেন।
সম্প্রতি অকশন হাউজ লিওনার্দ জোয়েলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হার্মিসের ব্যাগ কেনা মানে শুধু একটি ভ্যানিটি ব্যাগ কেনা না। একটি পেইন্টিং কেনা যেমনি নিজের ঘরে কোনো বিখ্যাত শিল্পীর কর্ম রেখে দেয়া, একইভাবে হার্মিসের ব্যাগ কেনা মানেও সবসময়ে হাতে করে আর্টের একটি টুকরা নিয়ে ঘোরাফেরা করা। এজন্যই রুচিশীল মানুষদের পছন্দের তালিকায় হার্মিসের অবস্থান সুউচ্চে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।