জুমবাংলা ডেস্ক : রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম এখন দেশ-বিদেশে। আঁশহীন, ছোট আঁটি, ছাল পাতলা আর সুস্বাদু হওয়ায় দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও চাহিদা বেড়েছে হাঁড়িভাঙার। নিজস্ব স্বকীয়তায় ইতোমধ্যে রংপুরের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
Table of Contents
প্রতি বছর হাঁড়িভাঙা আম জুনের ২০ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত শুরু হলেও এবার একটু আগেই পাওয়া যাবে।
কৃষি বিভাগ বলছে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ১২ থেকে ১৫ জুনের মধ্যে বাজারে পাওয়া যাবে এ আম। এবার ৩শ’ কোটি টাকার আম বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।
সরেজমিনে রংপুরের পদাগঞ্জের আম বাগানগুলো ঘুরে দেখা যায়, শেষ সময়ে আমের বিশেষ পরিচর্যায় ব্যস্ত আম চাষিরা।
আম চাষি রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আর কয়টা দিন গেলেই আমের হাট শুরু হবে। এ সময় যেন আমে কোনো সমস্যা না হয় সে জন্য ঘন ঘন স্প্রে করতেছি। আমের কালার যেন ঠিক থাকে সেদিকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হচ্ছে। সবঠিক থাকলে এবার ব্যবসা ভালো হবে।’
একই কথা বলেন বাগানি মশিউর রহমান। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘অনেক টাকা খরচ করছি বাগানের পিছনে। ঈদ পার হলেই আম বেচার ধুম পড়বে। এই সময়টা খুব যত্ন নিতে হয় আমের। পোঁকা, পাঁচানিসহ আমের কালার ঠিক রাখতে কীটনাশক ও ভিটামিন দিচ্ছি।’
আমচাষি আমিনুর রহমান বলেন, ‘এবার আম কম ধরলেও আকারে ভালো হয়েছে। তবে ঘন ঘন ঝড় বৃষ্টির কারনে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক দিতে খরচ বেশি হয়েছে। দামটা যদি ভালো না পাই তাহলে লোকসান গুনতে হবে।’
জয়নাল মিয়া নামে আরেক আম চাষি বলেন, ‘আমরা সার বছর এই আমের ওপর নির্ভর করি থাকি। আমের সিজনে যে টাকা পাই ওই টাকা দিয়ে সারা বছর চলা লাগে। তাই সরকার যদি আমাদের আম সংরক্ষণের জন্য একটা কোল্ড স্টোরেজ বানায় দিত তাহলে সেখানে আম রেখে আমরা সারা বছর বিক্রি করতে পারতাম। এতে একটু বেশি টাকা পাওয়া যেত।’
রংপুর জেলা কুষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক হাবিবুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, ‘চলতি বছর আবহাওয়া গরম থাকায় হাঁড়িভাঙা আগের থেকে কিছুটা আগেই বাজারজাত করা যাবে। তবে রফতানি যোগ্য আম সংগ্রহ করতে ২০ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সঠিকভাবে আম উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছি। আশা জরি কৃষকরা লাভবান হবেন।’
হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন ও লক্ষ্যমাত্রা:
বিষমুক্ত ও অতি সুমিষ্ট আঁশহীন হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। কয়েক বছর ধরে ফলন ভালো হওয়ায় বেড়ে চলেছে আম উৎপাদনের পরিধিও। রংপুরের সদর, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলা সহ বিভাগের অনেক বিস্তৃত এলাকার ফসলি জমি, বাগানসহ উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে চাষ হচ্ছে এই আম।
রংপুর বিভাগে এ বছর প্রায় তিন হাজার ২শ’ হেক্টর জমির বাগানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৮ হাজার মেট্রিক টন আম। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা।
সুস্বাদু হাঁড়িভাঙার গোড়াপত্তন:
হাঁড়িভাঙা আমের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকার নামে এক বৃক্ষবিলাসী মানুষ। স্বাধীনতার আগের বছর ১৯৭০ সালে নফল উদ্দিন পাইকার ১২০ বছর বয়সে মারা যান। এখন তার লাগানো হাঁড়িভাঙা গাছটির বয়স ৭৬ বছর।
নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন সময় সংবাদকে জানান, সম্ভবত ১৯৪৯ সাল, তখন তার বাবা নফল উদ্দিন এই গাছটি রোপণ করেছিলেন। উপজেলার বালুয়া মাসুমপুর গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার একটি জমি থেকে দুটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তার বাবা। তবে একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি (ফিল্টার সিস্টেমে) দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে।
তিনি আরও জানান, গাছটিতে এক সময় বিপুল পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চায়। তখন থেকেই গাছটি হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। এখন হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম মানুষের মুখে মুখে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাগান। তিনি হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটির সংরক্ষণের দাবি জানান।
হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারণ:
১৯৯২ সাল থেকে হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারণ শুরু হয় আখিরাহাটের আব্দুস সালাম সরকারের হাত ধরে। শুধু চাষবাদ নয়, এই অঞ্চলের হাঁড়িভাঙা সম্প্রসারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার হাত ধরেই রংপুর অঞ্চলের মানুষ এখন অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভের আশায় উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে প্রতিবছর হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
আব্দুস সালাম সরকার বলেন, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ করছি। টেকসই অর্থনীতির জন্য হাড়িভাঙ্গা আমের সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের দাবি করে আসছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই দাবি উপেক্ষিত হলেও আমের উৎপাদন ও বাগান সম্প্রসারণ থেমে নেই। সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙাকে ঘিরে এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে।
আম সংরক্ষণে গবেষণার দাবি:
চাষিরা বলছেন, হাঁড়িভাঙা আম পাকলে এটি তিন-চার দিনের বেশি রাখা যায় না। সংরক্ষণের কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই। যদি এই আম সংরক্ষণের সঠিক প্রক্রিয়া থাকত, তাহলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হতো।
রংপুর কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের ওপর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে। তবে কবে নাগাদ গবেষণার ফল আসবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। হাঁড়িভাঙার লাইফলাইন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা চলছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।