জুমবাংলা ডেস্ক : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, শীত নামতে আরও অন্তত একমাস বাকি। আর শীত নামলে রাজধানীবাসীকে যে দুঃসহ ভোগান্তি পোহাতে হয়, তার নাম ‘গ্যাস সংকট’। কিন্তু এবার শীত নামার আগেই এ সংকটে পড়েছে পুরো নগরবাসী। আবাসিক খাত তো রয়েছেই পাশাপাশি সিএনজি ফিলিং স্টেশন, শিল্প খাতেও পাওয়া যাচ্ছে না চাহিদামতো গ্যাস। ফলে সব আবাসিক, পরিবহন এমনকি শিল্প খাতের গ্রাহকদেরও পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। বিষয়টি সমাধানে কোনো পক্ষ থেকে কোনো পথ না দেখালেও একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে নিয়মিত। তিতাস বলছে, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) থেকে চাহিদামতো গ্যাস না পাওয়ায় কমাতে হচ্ছে সরবরাহ, আর পেট্রোবাংলা বলছে দেশীয় উৎপাদনের পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিও কমে গেছে। ফলে চাইলেও পাইপলাইনে চাহিদামতো বাড়ানো যাচ্ছে না গ্যাসের চাপ।
তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার বাসা-বাড়িতে জ্বলছে না চুলা। প্রতিদিনই তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে আসছে হাজার হাজার অভিযোগ। গ্যাস সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাসাবো, পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। এমনকি সংকট রয়েছে অভিজাত এলাকা বলে খ্যাত ধানম-ি, গুলশানেও। রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকার বাসিন্দা রাবেয়া আক্তার বলেন, শীতের সময় চুলায় গ্যাসের চাপ কম থাকে। এতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এবার শীতের নামগন্ধ না থাকলেও চুলায় আগুন জ্বলছে না। গ্যাসের চাপ কম। ভোর ছয়টা থেকে কমতে থাকে গ্যাসের চাপ। স্বাভাবিক হতে হতে রাত ১১টা বাজে। তখন আর কি কাজে লাগে গ্যাসের চুলা?
দিনে মাত্র ৪ ঘণ্টা চুলায় গ্যাসের চাপ থাকছে বলে জানান মিরপুর পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আহমেদ হোসেন। তিনি বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করি। কিন্তু বাসায় ফিরে চুলায় গ্যাস না থাকায় বেশিরভাগ দিনই বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। এমনিতে দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি তার ওপর যদি বেলায় বেলায় বাইরের খাবার কিনে খেতে হয় তাহলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষ টিকে থাকবে কিভাবে?
একই অবস্থা শিল্পাঞ্চলগুলোতেও। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পোশাক শিল্প-কারখানার মালিকদের। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের বেশিরভাগ কারখানাতেই গ্যাসের চাপ পাওয়া যাচ্ছে না চাহিদামাফিক। আগের বছরগুলোতে যেমনটি দেখা যেত শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমত। কিন্তু এবার এখনই সংকট তৈরি হয়ে গেছে। যদি এ রকমটি চলতে থাকে তাহলে তো গার্মেন্টস মালিকদের পথে বসে যেতে হবে। এমনিতেই করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সম্প্রতি আবার যোগ হওয়া ফিলিস্তিনি-ইসরাইল সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা। এখন বায়ারদের অর্ডার নিয়মিত সরবরাহ করতে না পারলে বিরাট অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হবে।
অক্টোবরের শুরু থেকেই নিজের কারখানায় গ্যাসের প্রেসার প্রায়দিনই জিরো থাকে জানিয়ে বিকেএমইএ সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, আমার কারখানাটা পুরনো হওয়ায় মেশিনগুলোতে ফার্নেস অয়েলের ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। জরুরি কাজ করি ফার্নেস অয়েল কিনে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?
এদিকে গত কয়েকদিন থেকে রাজধানীর সিএনজি স্টেশনগুলোতে ব্যাপক গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের চাপ না থাকায় সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে যানবাহনগুলোকে।
গাড়ি চালক ও মালিকরা বলছেন, গত সোমবার থেকে গ্যাস না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে। রাজধানীর মগবাজারে আনুদীপ সিএনজি স্টেশনে অপেক্ষারত সিএনজি অটোরিক্সা চালক রানা মিয়া বলেন, সিরিয়াল দিয়েছি তিন ঘণ্টা আগে। এখনো গ্যাস পাইনি। গ্যাস থাকলেও প্রেসার নেই। ৬০০ টাকার গ্যাস নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি মাত্র ৩০ কিলোমিটার। এভাবে কিভাবে পোষাবে? একটু গ্যাস কোথায় পাই তার জন্য এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ঘুরতাছি।
সিএনজি স্টেশনগুলো বলছে, গত রবিবার থেকেই সংকট দেখা দিয়েছে। সোমবার রাতে কিছু সময়ের জন্য গ্যাস এলেও মঙ্গলবার গ্যাস পাওয়া যায়নি। গ্যাসের বিষয়ে কখনো কোনো নোটিসও দেওয়া হয় না। এটা তাদের ইচ্ছামতো। যখন চলে যায়, আমরা বন্ধ রাখি। আবার যখন আসে আমরা চালু করি।
কেনো এই সংকট জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এক সময় সর্বোচ্চ ৩২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৪৮ কোটি ঘনফুট। দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা। কিন্তু একটি টার্মিনালে সমস্যা হওয়ায় প্রায় ১৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ঘোড়াশালের সার কারখানার একটি ইউনিট চালু হয়েছে যার কারণে চাহিদা বেড়েছে সেখানে। ফলে ঢাকায় সরবরাহ কমেছে। তাই সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।
এই সংকট মোকাবিলায় আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় কূপগুলোতে খননের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, এখন কাতারের এলএনজি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও চীন নিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে কাতার থেকে এলএনজি পাওয়াটা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে এসবের বাইরে আমদানির দিকে না তাকিয়ে পেট্রোবাংলাকে দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে দেশে গ্যাসের সংকট অনেকটাই কমবে। বিশেষ করে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে ‘ক্রাশ’ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে সরকার। দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে ২০২২-২০২৫ সালের মধ্যে পেট্রোবাংলার মোট ৪৬ টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ নাম দিয়ে এসব কূপে অনুসন্ধান, ওয়ার্কওভার, খনন ও উন্নয়ন কাজ শেষ করা হবে ২০২৪ সালের মধ্যেই। যদি এই প্রোগ্রাম সফলভাবে শেষ করা যায় তাহলে দেশের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভরতা অনেকটাই কমবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ বিষয়ে বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে এই সংকট আর থাকবে না। বাসাবাড়ির পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তবে এলএনজি আমদানির পাশাপাশি সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনের নানা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে মোট ৪৬টি কূপ খনন, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করা হবে।
৪৬টি কূপের মধ্যে রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রম ২টি, বাপেক্স ১টি কূপ খনন এবং বিজিএফসিএল ১টি ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে বাপেক্সের রিগগুলোর শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এর মাধ্যমে ৩টি অনুসন্ধান, ৫টি উন্নয়ন ও ১০টি ওয়ার্কওভার কূপ রয়েছে। বাকি কূপগুলোর মধ্যে ১৬-১৮টি বিদেশী সংস্থা, যাদের বাংলাদেশে খননের অভিজ্ঞতা ও রিগ আছে, তাদের দিয়ে খনন করা হবে।
দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শোয়েব বলেন, বিশ্বজুড়ে একটা জ্বালানি সংকট চলছে। এর থেকে বের হতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আমদানির জন্য নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি দেশীয় কূপগুলো খননেও জোর দেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা এসব পরিত্যক্ত কূপে নতুন করে অনুসন্ধান কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। এছাড়াও যে ৪৬টি কূপ ২০২২-২৫ সালের মধ্যে নতুন করে খনন, ওয়ার্কওভারের কথা ছিল, সেগুলোর সময়ও কমিয়ে এনে একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে আগামী ২০২৪ সালের মধ্যেই কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দৈনিক অন্তত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করেছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।