বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : জানা নেই, চেনাও নেই। কিন্তু তাতে কী? লাগবে না কোনো জামানতও। চাইলেই মিলছে ঋণ। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, কাঠখড় পুড়িয়ে, জুতার তলা ক্ষয় করেও যেখানে ঋণ পাওয়া যায় না, সেখানে কীভাবে এত সহজে সম্ভব? ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে এমন ঋণের ফাঁদ। না জেনে, না বুঝে কেউ কেউ সেই ফাঁদে পা দিচ্ছেন। পরিণতিতে পড়তে হচ্ছে বিপাকে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপে পাতা হচ্ছে ঋণের প্রলোভনের এমন ফাঁদ। মানুষ তাতে সাড়াও দিচ্ছেন। কেউ কেউ চড়া সুদে ঋণও পাচ্ছেন।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অ্যাপ ডাউনলোড করার পর নিবন্ধনের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন নম্বর এমনকি পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়া হয়। এরপর ফোনের সব তথ্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় অ্যাপ কর্তৃপক্ষ। শুরু হয় ছবি দিয়ে অশ্লীল ভিডিও বানিয়ে ব্ল্যাকমেল। বড় অংকের চাঁদা, না হয় হুমকি আসে প্রাণনাশের। অনলাইনে ঋণের ফাঁদের দুই একটি ঘটনা প্রকাশ পেলেও অনেকাংশেই অজানা থাকছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ‘অনলাইনে অ্যাপস থেকে ঋণ নেওয়া বা দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেই।’ এজন্য দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত এসব অ্যাপ ডাউনলোড না করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে এসব অ্যাপস নামালে নিয়মনীতি তুলে ধরা হয়। তিন হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ঋণ দেয় এসব অ্যাপস, যা ৩৬৫ দিনের মধ্যে পরিশোধের শর্ত যুক্ত করা হচ্ছে। তবে, ঋণের পরিমাণ কম হলে সময় কমিয়ে নির্ধারণ হয়। দেখা যায়, যারা প্রথম গ্রাহক তাদের সচরাচর ২০০০ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। আর ২০০০ টাকা ঋণ চাহিদা দিলে, এসব অ্যাপস গ্রাহককে দেবে ১৬৮৫ টাকা। তবে পরিশোধ করতে হবে ২০০৫ টাকা। এক্ষেত্রে কেটে রাখা হবে ৩১৫ টাকা। ঋণ পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয় সাত দিন।
তবে প্রথম গ্রাহককে কম পরিমাণ অর্থাৎ ১০০০ টাকাও সর্বনিম্ন ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জের নামে হচ্ছে ছলচাতুরী। বলা হয়, অ্যাপ্লিকেশন ফি বাবদ ১২০ টাকা, ডাটা অ্যানালাইসিস ফি ১৮০ টাকা, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ টাকা এবং সুদ বাবদ ৫ টাকা কেটে রাখার যুক্তি দেওয়া হয়। তবে পরিমাণ যত বেশি হবে টাকা কেটে রাখার প্রবণতাও বেশি। তথাকথিত ঋণের টাকা গ্রাহককে পরিশোধ করা হচ্ছে বিকাশ অথবা নগদ অ্যাকাউন্টে। অর্থাৎ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। ‘ক্যাশবক্স’ আইডি থেকে দাবি করা হচ্ছে, দুই লাখ লোককে ঋণ দেওয়ার সফলতা আছে তাদের। বাংলাদেশে এই প্রথম চাকরিজীবীদের জন্য সুদহীন ও জামানতহীন ঋণ সুবিধা দেওয়ার দাবি করছে ইনস্ট্যান্ট স্যালারিজ ডটকম নামে একটি অনলাইন পোর্টাল। বলা হচ্ছে, সাত কার্যদিবসের মধ্যে ঋণের ধরন জানা যাবে। পাওয়া যাবে টাকা।
দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে কেউ দিতে চায় ২০ হাজার টাকা, কেউ ৩০ হাজার টাকা। আবার কেউ কেউ বেতনের সমান ঋণ দেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধের শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সুদ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ শতাংশেরও বেশি। তবে এই ঋণ দেওয়ার বিপরীতেও আছে ভয়ংকর সব প্রতারণার গল্প। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনির হোসেন। হঠাৎ করেই টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিত জনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও জোগাড় করতে পারেননি প্রয়োজনীয় অর্থ। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রানক্যাশ নামের অ্যাপভিত্তিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পান তিনি। প্রতিষ্ঠানটি তিন থেকে ১২ মাস মেয়াদে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ঋণ দিয়ে থাকে।
অ্যাপটি ডাউনলোড করে অ্যাকাউন্ট খুলতে মনিরের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন নম্বর এমনকি পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়া হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে দশ হাজার টাকার ঋণের আবেদন করেন তিনি। এরপর মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে যখন টাকা চলে এল, তখন তিনি রীতিমতো খুশি। সুদসহ সেই টাকা শোধ করার পর এখন তাকে আরও টাকার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। মোবাইল ফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখান থেকে স্ত্রীর ছবি সরিয়ে তা ‘আপত্তিকর ভাবে এডিট’ করে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে হুমকি। মনির হোসেনের মতো আরও অনেকেই অ্যাপ ভিত্তিক ঋণ সেবার ফাঁদে পা দিয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন। কেউ আবার মান সম্মানের ভয়ে প্রতারকদের মোটা অংকের টাকা দিচ্ছেন। অনুসন্ধানে একই ধরনের আরও কিছু অ্যাপের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এগুলো হচ্ছে-টাকাওয়ালা, ক্যাশম্যান, এসম্যানেজার, ইনস্ট্যান্ট স্যালারি ডটকম, ফার্স্টক্যাশ, ক্যাশবক্স, গাইডলোন, ক্যাশক্যাশ। অনলাইনে ঋণগ্রহীতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে এসব অ্যাপে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নানা গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা। টাকার ছবি দিয়ে গ্রাফিক্স ছাড়াও অডিও-ভিজুয়াল বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন কেউ কেউ। চটকদার নানা কথায় মানুষের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট এসব অ্যাপ ও আইডি। এমনকি ১০ মিনিটেও ঋণ পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কেউ কেউ।
‘টাকায়ালা’ অ্যাপে থাকা ফোন নম্বরে ফোন দিলে কাস্টমার কেয়ার থেকে এ প্রতিবেদককে বলা হয়, এটি সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম। অফিস বা কোনো ধরনের ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়ার নিয়ম নেই।
বলা হয়, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে এনআইডি কার্ডের দুই পাশের ছবি, ঋণ যে নিতে চায় তার সেলফি, দুইজন আত্মীয়ের ছবিসহ অন্যান্য তথ্য দিতে হবে। প্রশ্ন ছিল, যদি কেউ টাকা নিয়ে ফেরত আর না দেয়, তাহলে? বলা হয়, প্রথমে ২ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হবে। পরে পরিশোধ করলে বেশি পরিমাণ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে এনআইডি কার্ডই জামানত। যদি টাকা না দেয়, তবে ঠিকানা ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঋণ কার্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমতি আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেই। বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন থেকে দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান খুলে একটি গ্রুপ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী এসব প্রতারণা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্বিকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘অনলাইনে অ্যাপস থেকে ঋণ নেওয়া বা দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু কোনো চক্র যদি অনলাইনে অ্যাপ খুলে ঋণ দেয় বা গ্রাহকরা নেয় সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না।’
তবে সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, অনলাইনে ঋণের যত অ্যাপ আছে সবগুলোই দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে খুব সহজেই কারও ব্যক্তিগত তথ্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য অনলাইন প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সতর্ক হতে হবে। লোভ সামলাতে হবে। অনলাইনে কারও সঙ্গে পরিচয় হলে সাবধান থাকতে হবে। না বুঝে না জেনে যে কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করা যাবে না।
জানতে চাইলে সিআইডির সাইবার শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) রেজাউল মাসুদ বলেন, অ্যাপসের মাধ্যমে ঋণ দিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। আবার ওয়েবপেজভিত্তিক ব্যবসা করতে চাইলে ই-কমার্স, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। এসব অনুমোদন না নিয়ে যদি তারা ঋণ বা লভ্যাংশ দেয়, তবে অবশ্যই সেটা প্রতারণা। তিনি বলেন, যদি কেউ অভিযোগ করে যে প্রতারিত হয়েছেন সেক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিচ্ছি। সূত্র : জনকণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।