জুমবাংলা ডেস্ক : আগামী বছরই জাতীয় নির্বাচন! নির্বাচন কবে? বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতার পালাবদলের পর কোটি মানুষের এখন এই প্রশ্ন। ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই স্পষ্ট করছে না। তবে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল নির্বাচন আগামী বছর নাগাদ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন। এর আগে সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন।
নির্বাচন কি আগামী বছরের মধ্যেই হতে যাচ্ছে? ঘোষণা না দিলেও সরকার কি ওই পথেই হাঁটছে? দেশজুড়ে এখন এটিই আলোচনার কেন্দ্রে। আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করা নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তবে নির্বাচনের ‘সময়’ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আশ্বস্ত হতে পারছে না বিএনপি। আইন উপদেষ্টার বক্তব্যের সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি জামায়াত।
অন্য দলগুলোর মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে, নির্বাচন করার আগে কী কী কাজ সম্পন্ন করতে হবে—তা অর্ন্তবর্তী সরকারের বিবেচনার বিষয়।
টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা ওই সরকারের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযোগ।
বিনা ভোটে নির্বাচন, হত্যা, গুম, খুন, ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমন, দুর্নীতি, অনিয়ম, দখলবাজি, সন্ত্রাসসহ বিস্তর অভিযোগের চূড়ান্ত পরিণতি হলো জনরোষে ক্ষমতা থেকে অপসারণ।
এমন প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানুষের প্রত্যাশার পাহাড়। নির্বাচনী ব্যবস্থা, আর্থিক খাত, বিচার বিভাগ, সংবিধান সংস্কার, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশসহ হাজারো সমস্যা নিরসনের চাপ। আড়াই মাস ক্ষমতায় থাকা এই সরকারের সামনে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সুশাসন ফেরানো যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনও আরো বড় চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে সরকার প্রধান খাতগুলোর সংস্কারের লক্ষ্যে পৃথক পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে দিয়েছে।
কমিটিগুলোকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পরই কী কী সংস্কার করা হবে, কত দিন লাগবে, তার একটা রূপরেখা সরকার পাবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওই সব সংস্কার প্রস্তাব হাতে পাওয়ার পরই সম্ভবত সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারবে।
তবে তার আগেই প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। দিন যত এগোচ্ছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। এসব দাবি ঘিরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমানে সংলাপও হচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দফা সংলাপ শেষ হয়েছে। আজ আরো একটি সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। এভাবে সংলাপসহ দলগুলোর নিজস্ব কর্মসূচি কিংবা সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন ফোরামে সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার চাপ বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন দাবিও করা হচ্ছে যে সংস্কার নির্বাচিত সরকার করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা।
নির্বাচনী চাপ আর আলোচনা, বিতর্কের মধ্যেই প্রথম দফায় সেনাপ্রধান রয়টার্সকে দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আভাস দিয়েছিলেন। আর সর্বশেষ আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে নিজের ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে জানিয়েছেন, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। দুটি বক্তব্য প্রচারের পর থেকেই আগামী নির্বাচন হওয়া নিয়ে একটি হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে জোর আলোচনা চলছে, তবে কি শেষ পর্যন্ত আগামী বছরের মধ্যেই নির্বাচন হতে চলেছে? সরকারের ভেতরের দুজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্য প্রায় মিলে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে নির্বাচনমুখী আলোচনা ডালপালা মেলতে শুরু করেছে।
ড. আসিফ নজরুলের মন্তব্যের পরই সর্বত্র যখন নির্বাচন হওয়া নিয়ে জোর আলোচনা চলছে, এ অবস্থার মধ্যেই গতকাল নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে কী কী কাজ সম্পন্ন করতে হবে সেই বিষয়গুলো অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনার বিষয়। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার সে সিদ্ধান্ত নেবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কারও সম্পন্ন হওয়া দরকার। সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য আমাদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয় হয়েছে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।’
জানা যায়, এই মুহূর্তে অসম মামলার চাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিএনপি ঘর গোছানোর ব্যানারে মূলত নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দলটির হতাশাগুলোকে আশার আলো দেখাচ্ছে। এ কারণে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি দলটির ভেতরে নব-উদ্দীপনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে দলটির নেতাকর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর দৌড়ঝাঁপই বলে দিচ্ছে যে জাতীয় নির্বাচনের ওপরই দলটির এখন মূল ফোকাস।
নির্বাচন নিয়ে সরকারের বক্তব্যে গরমিল আছে : তারেক রহমান
জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে এক আলোচনাসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন রকম বক্তব্য এসেছে। এমন একটি কাঙ্ক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যে গরমিল জনগণের মনে সন্দেহ ও সংশয়, উদ্বেগ করে। জনগণ সরকারকে আরো দায়িত্বশীল, গণমুখী ও কার্যকর দেখতে চায়।’
সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নির্বাচনপ্রক্রিয়া, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ—এই তিনটি সংস্কার করে অনুকূল নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারলে নির্বাচনটা খুব সুন্দরভাবে করা যাবে। আমরা দ্রুত এই তিনটি সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন চাই।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক রোডম্যাড দিতে হবে। নইলে জনমনে সংশয় দূর হবে না।
ধারণা পাওয়া গেল : জামায়াত
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই বক্তব্যের মাধ্যমে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া গেল।’ দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘আমরা দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচন চাই। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করতে বেশি সময় প্রয়োজন হওয়ার কথা না।’
সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ঘোষণা আসা উচিত : নুর
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘এই মুহূর্তে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সরকার হয়তো মনে করছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব। তাই নির্বাচন কোন সময়ে হবে তা নিয়ে আইন উপদেষ্টা বক্তব্য দিয়েছেন।’
কী ভাবছে আওয়ামী লীগ
বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়া আওয়ামী লীগ এখন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতের আশ্রয়ে। দলের শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগই পালিয়ে অথবা অন্তরালে। এমন অবস্থায় দলের সাংগঠিনক অবস্থা প্রায় নাজুক। এর সঙ্গে বিভিন্ন মহল থেকে দলটিকে নিষিদ্ধ করারও দাবি রয়েছে। ফলে দলটি শেষ পর্যন্ত কতটা নির্বাচনমুখী হতে পারবে—এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ সবার মধ্যে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে এখন মানবাধিকার, সুশাসন, বিচার—কিছুই নেই। আমাদের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খুনিদের দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এগুলো ঠিক করে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে অবাধ নির্বাচন দিক।’
আইন উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কেনন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা দ্রুত নির্বাচনের লক্ষণ দেখছেন না। আওয়ামী লীগ দ্রুত নির্বাচন চায়। রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশ ভালো চলতে পারে না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের পরপরই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্ক রেখে নির্বাচনের পথে হাঁটা দরকার।’
নির্বাচন ইস্যুতে আইন উপদেষ্টার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সরকারকে অনেক দিন ধরে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার কথা বলা হচ্ছে। আইন উপদেষ্টার কথার মধ্য দিয়ে অন্তত একটা ধারণা পাওয়া গেল। এ জন্য ধন্যবাদ জানাই। শুধু আইন উপদেষ্টার কাছে থেকে নির্বাচনের ধারণা নয়, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে হবে।’
বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘শুধু একজন উপদেষ্টার মন্তব্য নয়, সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর মতোমতের ভিত্তিতে দ্রুত নির্বাচনের দিন, তারিখ ঠিক করে তা জনগণকে জানানো।’
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে সংস্কার কর্মসূচিগুলো সম্পন্ন করতে পারলে আগামী বছর নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে। তবে সেই নির্বাচন যেন টেকসই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাওয়ার পথ সুগম করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।