জুমবাংলা ডেস্ক : বহরে নতুন উড়োজাহাজ যোগ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সঙ্গী বোয়িংয়ের উড়োজাহাজের চেয়ে ‘এয়ারবাস’র উড়োজাহাজের প্রতি আগ্রহ বেশি রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষরও (এমওইউ) সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২৭ সালে এয়ারবাসের এ৩৫০ সিরিজের দুটি উড়োজাহাজ যোগ হতে পারে বিমানের বহরে।
তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘদিনের সঙ্গী বোয়িংয়ের বাইরে গিয়ে নতুন সংস্থা এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কিনলে আর্থিক ক্ষতিতে পড়বে বিমান। পাশাপাশি সক্ষমতা না থাকায় দুই কোম্পানির উড়োজাহাজ মেইনটেনেন্স করতে বিমানকে বেগ পেতে হবে। বিশেষজ্ঞদের কেউ বলছেন, এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কিনলে অনেক লস হবে। আবার কেউ বলছেন, দুটি উড়োজাহাজ কিনলেও লস হবে। একসঙ্গে ১০টি কিনলে ভালো হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই কোম্পানির উড়োজাহাজ রাখলে লোকবল ও মেইনটেনেন্স খরচ বাড়বে। পৃথিবীর অনেক দেশ দুই কোম্পানির উড়োজাহাজ ব্যবহার করে। তাদের উড়োজাহাজের সংখ্যাও বেশি। কিন্তু বিমানের উড়োজাহাজ কম এবং বিমানের সক্ষমতাও কম।
এদিকে এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনার জন্য গঠিত বিমানের প্রথম কারিগরি-আর্থিক মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এয়ারবাসের দুটি এ৩৫০ উড়োজাহাজ কিনলে তাদের বড় ধরনের লোকসান হবে। এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কেনা হলে এর জন্য বিমানকে ২৫ বছরে (উড়োজাহাজের জীবনকাল) ৪৬৩ দশমিক শূন্য ৮ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত নগদ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে। এরপর গত ২২ এপ্রিল একটি নতুন কমিটিকে বিষয়টি মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং মাত্র তিন দিনের মধ্যে নতুন কমিটি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, দুটি এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কেনা লাভজনক হবে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এটি লাভজনক হবে, যদি কেবিন ফ্যাক্টর ৯২ শতাংশ হয়। কেবিন ফ্যাক্টর বলতে বোঝায়, গড়ে ফ্লাইটের কত শতাংশ আসন পূরণ করা হয়েছে। এমনকি নতুন এ সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে বিমান বোর্ড চারটি এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কেনার অনুমোদনও দিয়েছে। এর প্রতিটির দাম প্রায় ১৮০ মিলিয়ন ডলার।
গণমাধ্যমেও এমন খবর এসেছে। তবে তা সঠিক নয় দাবি করে বিমান বলছে, কোনো নতুন বা দ্বিতীয় কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। ওই কমিটির চেয়ারম্যান স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কারণে কো-চেয়ারম্যানকে বিদ্যমান টেকনো-ফাইন্যান্সিয়াল কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়। অন্যান্য এয়ারলাইন্স যেসব স্ট্যান্ডার্ড অ্যাপ ব্যবহার করে টিকেটের মূল্য, জ্বালানি ব্যয় এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ ও উপার্জনের ওঠানামার বিষয়গুলো হিসাব করে সেই একই অ্যাপ ওই কমিটি তাদের কাজে ব্যবহার করেছে। তারা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রয়-সংক্রান্ত সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে।
সংস্থাটি বলছে, বহরে নতুন উড়োজাহাজ সংযুক্ত করার জন্য বিমানের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। কোনোরকম ব্যত্যয় ঘটানো ছাড়াই সেই নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করে উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এয়ারবাসের উড়োজাহাজ কেনা ও এভিয়েশন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে একটি যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরের মাধ্যমে এয়ারবাসের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে বিমানের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ব্যবসায়িক অংশীদার উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং কোম্পানির সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা চলমান।
এ বিষয়ে বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, আপাতদৃষ্টিতে বুঝি যে, দুই ধরনের উড়োজাহাজ রাখলে স্বাভাবিকভাবেই মেইনটেনেন্স, অপারেশন খরচসহ অনেক ধরনের খরচ বেড়ে যাবে। আমাদের মোটে ২০-২২টি উড়োজাহাজ। ‘মিক্স ফ্লিট’ (ফ্লাইটের বহর) কখন হয়? যখন দুই-চারশ প্লেন থাকে। তখন দুইশ এয়ারবাস থাকল, দুইশ বোয়িং বা অন্য কোম্পানির থাকল, তা হলে একটা ব্যালেন্স হয়। এখন আমাদের এয়ারক্রাফটই আছে ২০-২২টি। এ ছোট ফ্লিট নিয়ে কী করে মিক্স ফ্লিট সম্ভব? এখানে ক্যাপ্টেনের সংকট আছে, কেবিন ক্রুর সংকট আছে। তিনি বলেন, বিমানের প্রথম মূল্যায়ন কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিল সেটি ব্যালেন্স রিপোর্ট ছিল। তারা বাস্তবভিত্তিক একটা চিন্তা করে রিপোর্ট দিয়েছিল। তাদের প্রতিটি পয়েন্ট জাস্টিফায়েড মনে হয়েছে। তাদের রিপোর্ট কেন বাদ দেওয়া হলো, কোন জায়গায় তাদের সমস্যা সেটি তো বলেনি। আরেক কমিটি কেনার পক্ষে রিপোর্ট দিয়েছে, এটিতে ডেফিনিটলি সন্দেহের অবকাশ রয়ে যায়।
তবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বলছেন ভিন্ন কথা।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, বিমানের উচিত অন্তত ১০টি এয়ারবাস অর্ডার করা। এখন দুটি অর্ডার করলে খরচ বেশি হবে। পৃথিবীর কোথাও পাবেন না যারা একটিমাত্র সংস্থার উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লিট পরিচালনা করে।
তিনি বলেন, এয়ারবাসের প্রাইমারি দাম বেশি হলেও তেল খরচ কম, অপারেশন কস্ট কম। সব রুটে একই উড়োজাহাজ দিয়ে চালানো ঠিক নয়। যতটা বলা হচ্ছে, খরচ বাড়বে, অতটা বাড়বে না। একটি বা দুটি কিনলে খরচ বাড়বে। বিমানের উচিত একসঙ্গে ১০টি এয়ারবাস অর্ডার করা। কারণ তাদের যে চাহিদা সে হিসেবে আরও ২০টি উড়োজাহাজ নিয়ে নেওয়া উচিত। তাদের আরও রুট বাড়াতে হবে। ৫০ বছরের এ এয়ারলাইন্সকে দেখে মনে হয় ১০ বছরের এয়ারলাইন্স। ফ্লাইটের অভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো গেল না। পর্যাপ্ত ফ্লাইট না থাকায় এক মাস আগে হজে যেতে হয়। বেশি উড়োজাহাজ থাকলে ১৫ দিন আগে পাঠালেই হতো। ১৫ দিনের প্যাকেজ হলে হজের খরচও কমে আসত।
এ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন ধরনের এয়ারক্রাফট দরকার হয়। লন্ডনের জন্য ৭৮৭ ভালো। কিন্তু এটি দিয়ে ব্যাংকক-মাস্কাট ফ্লাই করা হয়। এটি রং। রুটের সঙ্গে এয়ারক্রাফটের সামঞ্জস্য থাকতে হবে। না হলে ফুয়েল ইকোনমি হয় না। প্রয়োজনে ছোট এয়ারক্রাফট দিয়ে চালাতে হবে। প্রয়োজনে ৪টি ফ্লাইট দেওয়া যায়। তিনি বলেন, বড় রুটগুলোতে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে, নেটওয়ার্কিং বাড়াতে হবে। বহরে ভালো এয়ারক্রফট লাগবে। শুধু বাংলাদেশ বিমান নয়, যেকোনো এয়ারলাইন্সের জন্য ভিন্নতা থাকা দরকার। বড় ধরনের এয়ারলাইন্সে দুই ধরনের উড়োজাহাজ থাকলে বার্গেনিং পয়েন্ট বাড়ে। এয়ারবাসের দাম একটু বেশি। কিন্তু লং টার্ম চিন্তা করতে হবে। যখন এয়ারবাসের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট হবে তখন বোয়িং বলবে, দাম কমাব, আমারটা নাও। আবার এয়ারবাসও দাম কমাবে। একটা বার্গেইনিং সিচুয়েশন ক্রিয়েট হবে। সব দেশই এটি করে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স বিমান বাংলাদেশের ফ্লিট সম্প্রসারণের জন্য আমরা নতুন উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। সেই প্রস্তাবটি মূল্যায়নের জন্য বিমানে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এরই মধ্যে বোয়িং কোম্পানিও তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এটিও যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি করা হবে। বাংলাদেশ ও বিমানের জন্য যেটি ভালো হবে সেটিই করা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।