মাহবুব মমতাজী : অন্যরকম উদাহরণ তৈরি করেছেন ঢাকার পাশের একটি গ্রামের নারীরা। এই গ্রামের প্রায় সব নারীই উদ্যোক্তা। এ দৃশ্য চোখে পড়বে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গঙ্গানগর গ্রামে। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগে কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পাশাপাশি অন্যদের জন্যও সুযোগ তৈরি করেছেন নারীরা। ঢাকার ডেমরার পূর্বদিকের শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে কিছুদূর গেলেই গঙ্গানগর গ্রাম। রাস্তা ধরে কিছুদূর যেতেই হাতের বাম পাশে চোখে পড়বে ছোট ছোট অনেক বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠা একটি গ্রাম। প্রতিটি বাড়ির ঘরের বারান্দায় বসানো হয়েছে তাঁতকল। যেখানে যে যার মতো করে বুনছেন জামদানি শাড়ি। বাহারি ধরনের একেকটি শাড়ির দাম ৭ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে।
গত ৮ জুন গঙ্গানগর গ্রামে গিয়ে জানা যায় এসব। মূল সড়ক থেকে গলিপথে গ্রামের একটু ভিতরে গেলেই চোখে পড়ে বড় একটি জামদানি শাড়ির কারখানা। এটি মাহমুদা (৪০) নামে এক গৃহবধূর। সেখানে কাজ করেন তার স্বামীসহ অন্তত ৪০ জন শ্রমিক। তখন কারখানার সামনের কলটিতে বসে মনের মাধুরী মিশিয়ে সুতা বুনছিলেন মাহমুদার স্বামী ইয়াদ আলী (৪৫)। আর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী মাহমুদা। কারখানাটি তাদের বাড়ির আঙিনায় ৫ শতাংশ জায়গার ওপর গড়ে তোলা।
সফল নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই মাহমুদাও অন্যতম। তিনি জানান, তার স্বামী আগে অন্যের কারখানায় কারিগরের কাজ করতেন। এরপর গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ছোট পরিসরে একটি কারখানা নিজেরাই দেন। কারখানার একটি তাঁতকল থেকে এখন তাদের ২০টি তাঁতকল। একেকটি তাঁতকল বানাতে তাদের খরচ হয়েছে অন্তত ১০ হাজার টাকা করে। কারখানায় যেসব কর্মচারী রয়েছেন, তাদের অগ্রিম ১ লাখ টাকা করে দিয়ে রাখতে হয়েছে। কাউকে ৫০ হাজার, আবার কাউকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে রেখেছেন। কর্মচারীদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় শাড়ির প্রকারভেদে। যে শাড়ির দাম ১০ হাজার টাকা, সেখানে কর্মচারীই নিয়ে নেন ৫ হাজার টাকা। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে কারখানাটি আরও বড় করেছেন মাহমুদা।
জামদানি শাড়ির তাঁত বুনতে বুনতে ইয়াদ আলী এ প্রতিবেদককে বলছিলেন, তিনি যে জামদানি শাড়িটি বুনছেন সেটি শেষ হতে সময় লাগবে এক সপ্তাহ। তার হাতে বুনা জামদানি শাড়িটির পাইকারি মূল্য আছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। তিনি এসব জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ করে আসছেন ১২ বছর ধরে। ছোটকাল থেকেই তিনি তার পাশের এলাকা রূপসীতে জামদানির কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতে করতে কারিগর হয়েছেন। এখন তার কারখানায় সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় হয়। ইয়াদ আলীর ভাষ্য, ‘শুরুতে আমি আমার মায়ের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম, আমার বিয়ের পর আমার স্ত্রীর মাধ্যমে সহায়তা পেয়েছি’।
মাহমুদাদের বাড়ির পাশেই দেখা মেলে আরেকটি জামদানি কারখানার। ঘরের বারান্দায় তাঁতকল বসিয়ে শাড়ি বানানোর কাজ করছিলেন এক নারী। তিনি তার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে শাড়ি বানাচ্ছিলেন। এ দম্পতি জানান, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তারা শাড়ির তাঁত বুনার কাজ করেন। এভাবে টানা সাত দিন কাজ করার পর একটি শাড়ি তৈরি হয়। এ দম্পতিও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে কারখানাটি গড়ে তোলেন। তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন এবং এক ছেলে ও এক মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
এদের ঘরের পাশেই আরেকটি ঘরের বারান্দায় দেখা মেলে আরিফা নামে এক নারীর কারখানা। তিনি বলেন, একটি জামদানি বানাতে সুতা লাগে আর জরি লাগে। তার কাজে তাকে প্রতিদিন তার স্বামী সামাদ সহযোগিতা করেন। যে মহাজন শাড়ি কিনে নেন তিনিই সুতা আর জরি সরবরাহ করেন। তবে মহাজন শাড়ি থেকে ১ হাজার টাকা কেটে রাখেন সুতা আর জরির দাম বাবদ। যদি মহাজনের কাছ থেকে সুতা-জরি না নেন, তাহলে তা ডেমরা থেকে কিনে আনেন তারা। আরিফা জামদানি শাড়ির কাজ শিখেছেন তার স্বামীর কাছ থেকেই। আরিফার ঘরের পেছনে দেখা যায় আরেক নারীর কারখানা। তাদের বাড়ির সামনে ঘরের ভিতরে গড়ে তোলা একটি কারখানায় মাজেদা ও তার ছেলে মাসুমকে জামদানি শাড়ি বানাতে দেখা যায়।
পুরো গ্রামটি ঘুরে দেখা গেল, অন্তত ৮০ জন নারী গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ছোট ছোট পরিসরে গড়ে তুলেছেন জামদানি শাড়ির কারখানা। পুরো গ্রামটিতে আছে প্রায় ৫০০ জামদানি শাড়ির কারখানা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে গ্রামীণ ব্যাংকের সুবিধাভোগীরা তাঁত, টেক্সটাইল উৎপাদন, পশুপালন, মিষ্টি তৈরি, বিউটি পারলার এবং জুয়েলারিসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
সোনারগাঁ উপজেলার নয়াপুর বাজারে মিষ্টি তৈরি করে সরবরাহকারী কৃত্তিবাস ভোমিক জানান, প্রায় দুই দশক আগে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে এই ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বলেন, একবার ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য আমাদের কিছু অর্থের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু কেউ অর্থের জন্য আমাদের সাহায্যে আসেনি। তারপর আমার স্ত্রী প্রায় ১৫ বছর আগে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণের জন্য আবেদন করেছিলেন। এরপর ব্যবসা শুরু করি। এখন ঋণের পরিমাণ ১০ লাখে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই ছোট ব্যবসায় অন্তত ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) এবং নারায়ণগঞ্জ জোনাল ম্যানেজার আবুল কালাম বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী আমাদের প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে সুবিধাভোগীদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে। যোগ্য সদস্যরা কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই ঋণ পান, যা গ্রামীণ ব্যাংকের অনন্য বৈশিষ্ট্য। বেশির ভাগ ঋণগ্রহীতার জন্য সুদের হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকে, যা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রদান করা প্রয়োজন। তবে উচ্চশিক্ষার জন্য ঋণ রয়েছে যা সুদমুক্ত। সুবিধাভোগীরা তাদের উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর পরিষেবা চার্জসহ পরিশোধ করেন।
তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জ জোনে ব্যাংকটির প্রায় ২ লাখ ৮২ হাজার সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার জন ঋণ নিয়ে বিভিন্ন কাজে লাগিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে তাদের ৬২টি শাখা রয়েছে, যার প্রতিটিতে প্রায় ১০ জন লোক নিয়ে ৬০-৭০টি কেন্দ্র রয়েছে। তারা নবীন উদ্যোক্তাদেরও ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকেন।
ঢাকার ডেমরায় পারভেজ নামে এক যুবক মোবাইল ফোনের চার্জার ও কাভার দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। ২০১৪ সালে তিনি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন থেকে ডিপ্লোমা শেষ করেন। এরপর দুই বছর চাকরির চেষ্টা করেন। চাকরি না পেয়ে কিছু করার কথা ভাবেন। তার মা পারুল বেগম (৫৫) গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ সহায়তা নিয়ে ছেলেকে দিয়ে এ ব্যবসা ধরিয়ে দেন। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।