ধর্ম ডেস্ক : রমজানের রোজা প্রত্যেক সুস্থ সাবালেগ মুসলিমের ওপর ফরজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা: ১৮৩)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে।’ (সুরা বাকরা: ১৮৫)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- إذا رأيتم الهلال فصوموا وإذا رأيتموه فافطروا، فإن غم عليكم فصوموا ثلاثين، وفي رواية : صوموا لرؤيته وأفطروا لرويته، فإن عم عليكم فاكملوا العدد ‘যখন তোমরা (রমজানের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা রাখবে আর যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ত্রিশ দিন রোজা রাখবে।’ (সহিহ বুখারি: ১৯০৯; সহিহ মুসলিম: ১০৮০)
রমজান মাসের একদিন রোজা না রাখলে মানুষ শুধু গুনাহগারই হয় না, ওই রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখলেও রমজানের এক রোজার যে মর্যাদা ও কল্যাণ, তা লাভ করা সম্ভব না এবং কোনোভাবেই এর ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন- من افطر يوما من رمضان متعمدا من غير سفر ولا مرض لم يقضه ابدا، وان صام الدهر كله، … وقد ذكره البخاري تعليقا بصيغة الجزم حيث قال : وبه قال ابن مسعود، وقال الشيخ محمد عوامه : وهذا الحديث موقوف لفظا ومرفوع حكما ‘যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজাও ভঙ্গ করে, সে আজীবন রোজা রাখলেও ওই রোজার হক আদায় হবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৯৮৯৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক: ৭৪৭৬; সহিহ বুখারি: ৪/১৬০)
প্রত্যেক নেক আমলের নির্ধারিত সওয়াব ও প্রতিদান রয়েছে, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমলকারীকে পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু রোজার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ রোজার বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ তাআলার ঘোষণা রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- كل عمل ابن آدم يضاعف الحسنة بعشر أمثالها إلى سبعمائة ضعف، قال الله تعالى : الا الصوم فإنه لى وانا أجزى به يدع شهوته وطعامه من أجلى ‘মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকির সওয়াব দশগুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, কিন্তু রোজা আলাদা। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে ‘ (সহিহ মুসলিম: ১১৫১; মুসনাদে আহমদ: ৯৭১৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৮৯৮৭; ইবনে মাজাহ: ১৬৩৮)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন- يترك طعامه وشرابه وشهوته من أجلى، الصيام لى وانا اجزى به، والحسنة بعشر امثالها ‘বান্দা একমাত্র আমার জন্য তার পানাহার ও কামাচার বর্জন করে, রোজা আমার জন্যই, আমি নিজেই তার পুরস্কার দিব আর (অন্যান্য) নেক আমলের বিনিময় হচ্ছে তার দশগুণ।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৯৪; মুসনাদে আহমদ: ৯৯৯৯; মুয়াত্তা মালেক: ১/৩১০)
রোজা বিষয়ে অন্য বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘প্রত্যেক ইবাদতই ইবাদতকারী ব্যক্তির জন্য, পক্ষান্তরে রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব।’ (সহিহ বুখারি: ১৯০৪)
এখানে অনেকগুলো হাদিস দেখতে পাচ্ছি যেখানে আল্লাহ তাআলা রোজাদারের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এর তাৎপর্য হলো- যদিও প্রকৃতপক্ষে সকল ইবাদতই আল্লাহর জন্য, তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। তবুও রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। তা হলো- অন্যান্য সকল ইবাদতের কাঠামোগত ক্রিয়াকলাপ, আকার-আকৃতি ও নিয়ম পদ্ধতি এমন যে, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ছাড়াও ইবাদতকারীর নফসের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান থাকে। মুখে প্রকাশ না করলেও অনেক সময় তার অন্তরে রিয়া তথা লোক দেখানো ভাব সৃষ্টি হতে পারে। তার অনুভূতির অন্তরালে এ ধরনের ভাব লুকিয়ে থাকে। তা সে অনুভব করতে না পারলেও তার ভিতরে অবচেতনভাবে বিদ্যমান থাকে। ফলে সেখানে নফসের প্রভাব এসে যায়।
পক্ষান্তরে রোজা এমন এক পদ্ধতিগত ইবাদত, তার-আকার-আকৃতি এরূপ যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত ইবাদতকারীর নফসের স্বাদ গ্রহণের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। রোজাদার ব্যক্তি নিজ মুখে রোজার বিষয়টি প্রকাশ না করলে সাধারণত তা আলেমুল গায়েব আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কারো নিকট প্রকাশিত হওয়ার মতো নয়। তাই রোজার ক্ষেত্রে মাওলার সন্তুষ্টির বিষয়টি একনিষ্ঠভাবে প্রতিভাত হয়। একারণেই রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের মাঝে এরূপ বিস্তর ব্যবধান।
বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, আল্লাহ তাআলা নিজেই যখন রোজাদারকে পুরস্কার দিবেন, তখন এর পরিমাণ কত হতে পারে! ইমাম আওযায়ি (রহ) বলেন- আল্লাহ যে রোজাদারকে প্রতিদান দিবেন, তা মাপা হবে না, ওজন করা হবে না অর্থাৎ বিনা হিসাবেই দিবেন।
রোজার আরও অনেক ফজিলত রয়েছে। যেমন- রোজাদারের জন্য জান্নাতে রাইয়ান নামের বিশেষ দরজা থাকবে। যেই দরজা দিয়ে শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করতে পারবেন। জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ বলা হয়েছে রোজাকে। হজরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আমাদের মহান রব ইরশাদ করেছেন- রোজা হল ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য আর আমিই এর পুরস্কার দিব।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৪৬৬৯; শুয়াবুল ঈমান বাইহাকি: ৩৫৭০)
রোজাদার পরকালে সিদ্দিক ও শহিদদের দলভুক্ত থাকবেন। আমর ইবনে মুররা আলজুহানি (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে এসে বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি যদি একথার সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং অবশ্যই আপনি আল্লাহর রাসূল, আর আমি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, জাকাত প্রদান করি, রমজান মাসের সিয়াম ও কিয়াম (তারাবিহসহ অন্যান্য নফল) আদায় করি তাহলে আমি কাদের দলভুক্ত হব? তিনি বললেন, সিদ্দিকিন ও শহীদগণের দলভুক্ত হবে।’ (মুসনাদে বাজজার: ২৫, সহিহ ইবনে খুজাইমা: ২২১২, সহিহ ইবনে হিববান: ৩৪২৯)
তাছাড়া রোজাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- ‘ইফতারের সময় রোজাদার যখন দোয়া করে, তখন তার দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (অর্থাৎ তার দুআ কবুল হয়)। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৭৫৩)
শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া রোজা ত্যাগ করা কবিরা গুনাহ। কেননা রোজা রাখার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহর। যে ব্যক্তি শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া রোজা ত্যাগ করল সে ইসলামের রুকন ও ফরজ বিধান ত্যাগ করল। এই একটি কবিরা গুনাহই মানুষের জাহান্নামি হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘ইসলামের হাতল ও দ্বিনের মূল বিষয় তিনটি; যার ওপর ইসলামের ভিত্তি। যে ব্যক্তি তার একটি ত্যাগ করল, সে এমন অবিশ্বাসীতে পরিণত হলো, যার রক্তপাত বৈধ। সেগুলো হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই বলে সাক্ষ্য দেওয়া, ফরজ নামাজ ও রমজানের রোজা।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ: ১/৪৮)
ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেন, মুমিনদের কাছে এ কথা প্রমাণিত, যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থতা ও শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া রোজা ছেড়ে দেয় সে মদ্যপ ও ব্যভিচারকারীর চেয়েও নিকৃষ্ট; বরং তারা তার ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ করে এবং তাকে জিন্দিক তথা ধর্মদ্রোহী বলে সন্দেহ করে। (আল-কাবায়ির, পৃষ্ঠা-৬৪)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি প্রয়োজন ও রোগ ছাড়া রমজানের একটি রোজা ভেঙে ফেলল, তার সারা জীবনের রোজা দ্বারাও এ কাজা আদায় হবে না, যদিও সে সারা জীবন রোজা পালন করে।’ (সুনানে তিরমিজি: ৭২৩)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।