জুমবাংলা ডেস্ক : সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘কাবেরী’। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন টালিউড অভিনেত্রী পাওলি দাম। গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে এ সিরিজ। তবে অভিনেত্রী কখনো লিঙ্গবৈষম্যের মধ্যে বড় হননি, তাই ‘কাবেরী’ চরিত্রটি আত্মস্থ করতে তার অসুবিধা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী বিশদ কথা বলেছেন আনন্দবাজার অনলাইনের এক সাক্ষাৎকারে।
তিনি বলেন, অর্জুন আমার থেকে ছোট বয়সে। কোথাও ঘুরতে গিয়ে মনে হয়েছে, ওর হয়তো এই জিনিসটা পছন্দ। আমি কিন্তু ওকে কিনে দিতে পেরেছি। বাংলা ছবি করে আমি কত টাকা পাই? বাংলা ছবি কাকে কতটা দিয়েছে বলে জানান এ অভিনেত্রী।
গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হলেও অধিকাংশ নারী সন্তানের কথা ভেবে সেই ক্ষতিকারক বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসতে চান না। এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন এমন প্রশ্নের উত্তরে পাওলি বলেন, পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের মজ্জায় এমন ভাবে জেঁকে বসেছে, মনে হয় পুরুষই তো, রাগের মাথায় করে ফেলেছে। আমারই তো সংসার। সমাজ আমাদের সেভাবেই শিখিয়েছে। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের ওপরেও আমরা অনেক কিছু চাপিয়ে দিই নিজেদের অজান্তে। ‘কাবেরী’ চরিত্রটি আত্মস্থ করতে আমার খুব অসুবিধা হয়েছিল। আমি কোনো দিন লিঙ্গবৈষম্যের মধ্যে বড় হইনি। বাড়ি তো বাদই দিলাম, আমার আশপাশেও কাউকে দেখিনি। গৃহিণী দেখেছি। আমার মা-ও গৃহিণী, কিন্তু স্পষ্ট মতামত রাখেন সব সময়। বাড়ির অন্দরে কোনো ধরনের বৈষম্য জায়গাই পাবে না।
সিরিজে দেখা যাচ্ছে স্ত্রীকে অত্যাচার করা হচ্ছে। তার পর তাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে, এটিও কিন্তু বাস্তবের একটি বহুল প্রচলিত নমুনা…। উত্তরে পাওলি বলেন, এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি— আমি আগে ভাবতাম শিক্ষিত হলেই এসব থেকে বেরিয়ে আসা সহজ। কিন্তু আসলে তা হয় না। ‘কাবেরী দত্ত’ অঙ্কের শিক্ষিকা, কিন্তু বাড়িতে তিনি অবদমিত, অত্যাচারিত। আমি চিত্রনাট্য হাতে পাওয়ার পর ভেবেছিলাম, আমি ‘কাবেরী’ নই। কিন্তু চারদিকে কত ‘কাবেরী’ রয়েছেন, যারা আওয়াজ তুলতে পারেন না।
বাড়ির পরিবেশের ওপর নির্ভর করে সন্তানের মানসিক গঠন কেমন হবে। ছোটবেলা থেকে যদি সন্তান এ ধরনের আচার-আচরণ দেখে বড় হয়, সে-ও একই অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। গার্হস্থ্য হিংসা রুখতে কড়া আইন জারি করা প্রয়োজন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। অর্থনৈতিক ভেদাভেদ, সামাজিক ভেদাভেদ, শিক্ষার ভেদাভেদ রয়েছে। সময় লাগুক, কিন্তু উত্তরণ ঘটুক।
টালিউডের অন্দরে হেমা কমিটির আদলে কমিটি তৈরি হয়েছে—এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী বলেন, হ্যাঁ, আমি তো পিটিশনে সই করেছিলাম। আমি নিজে সরাসরি ঘটনার সম্মুখীন হইনি বলে পাশে দাঁড়াব না? এটা কখনো হয়! আমি নিজে মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের পাশে দাঁড়াব না?
তিনি বলেন, এই যে মেয়েরা মেয়েদের পাশে দাঁড়ায় না, এটিও কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিখিয়ে দেওয়া। যে অভিনেত্রী আওয়াজ তুলেছে, সে আমাকে বলেছিল—জানো তো, অভিযোগ জানানোর পর অনেকে আমাকে বলেছে, আমাকে আর কেউ শুটিংয়ে ডাকবে না। সব কিছুতেই ক্ষমতার অপব্যবহার!
নারীদের পোশাক নিয়ে অনেক নারীই কটাক্ষ করেন, সে প্রসঙ্গে পাওলি বলেন, সেটা তো তাদের জীবনবোধ, তাদের জীবনদর্শন। তিনি বলেন, আমার মানসিকতা, সাজপোশাক উনিশ শতকের সঙ্গে মিলবে না। আমি তো আমার পরিবেশ থেকেই শিখব। জন্মের পর মা-বাবার শেখানো বিষয় আত্মস্থ করি। জীবনে চলার পথে বন্ধুবান্ধবের থেকে কিছু শিখি, আর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে বেশ কিছু দর্শন তৈরি হয়।
আরজি করকাণ্ডে যে তারকারা পথে নামলেন, হেমা কমিটি নিয়ে যারা কথা বললেন, তারা ট্রলের মুখে পড়েছেন। পুরো টালিউডে উদ্বেগ—এমন প্রশ্নের উত্তরে অভিনেত্রী বলেন, এটা একেবারেই কাম্য নয়। কণ্ঠস্বর মেলাতে হবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। এই যে নেতিবাচক আলোচনাগুলো হলো, তাতে আমরা একধাপ হলেও পিছিয়ে গেলাম। ফলে আমাদের অনেক চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে, কী বলব না বলব— কতটা বলব। তিনি বলেন, কেন এত ভেবে, হিসাব কষে কথা বলতে হবে আমাদের? এই সময় আমাদের একটু দৃঢ়তা বজায় রাখতে হবে। আমি বুঝতে পারছি কোন জায়গা থেকে মানুষের রাগ ও দুঃখ আসছে, কিন্তু আমাদের সবার পাশে থাকা উচিত।
পাওলি দাম বলেন, আমি আমার কাজও করব, প্রতিবাদও করব। কাজ বন্ধ করতে পারি না, সবার তো সংসার আছে। পেশা ও আন্দোলন পাশাপাশি চলুক। পেটে অন্ন না থাকলে গলা থেকে আওয়াজ বেরোবে না।
ওটিটিতে কাজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে পাওলি বলেন, আমি তো অনেক আগেই ওটিটিতে কাজ করেছি। দর্শক ভুলে যান। ভাবেন ‘কালী’ হিন্দি ওয়েব সিরিজ। আসলে সেই সময় ওটিটি নতুন এসেছে। মানুষ জানতেন না কীভাবে ডাউনলোড বা সাবস্ক্রাইব করতে হয়। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেসও করতেন কীভাবে সিরিজটি বাংলা ভাষায় দেখতে পাবেন। বেশিরভাগ মানুষ হিন্দি ডাব দেখেছে।
আর প্রেক্ষাগৃহে বাংলা ছবি দেখার প্রবণতা ক্রমশ কমছে, সে প্রসঙ্গে অভিনেত্রী বলেন, সে রকম বিষয় রাখতে হবে ছবিতে। ছবির বিষয়বস্তু ঠিক হলে, ছবি নিশ্চয়ই চলবে। সহজ-সরল গল্প থেকে আমরা কেমন যেন দূরে সরে গিয়ে জটিল বিষয় রাখছি। ভালো লেখা হচ্ছে না আমাদের। সেই কারণে গত এক বছরে প্রচুর চিত্রনাট্য শুনেই না করে দিয়েছি আমি। নারী বিদ্বেষমূলক ছবি বা প্রচারমূলক ছবি করতে পারব না আমি।
টালিউড ইন্ডাস্ট্রিতি নায়িকারা চুলোচুলি করেন। ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে এ ধারণা বহুদিনের। কিন্তু সম্প্রতি এটাই দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুধু তা-ই নয়, কোনো ব্যক্তি মতামত রাখলে তা যদি পছন্দ না হয়, তাকে একঘরে করে দেওয়া হচ্ছে। যেমন শ্রীলেখা মিত্র বা কাঞ্চন মল্লিক। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী? উত্তরে পাওলি দাম বলেন, কিন্তু তা বলে বলব না, সেটি তো হয় না। তিনিও তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই মন্তব্য করেছিলেন। তাই তাকে সামাজিকমাধ্যমেই উত্তর দেওয়া হয়েছে। আমি যে কাঞ্চনদাকে চিনতাম, তিনি জীবনে লড়াই করে এ জায়গায় পৌঁছেছেন। দলীয় রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন তিনি, তার অনেক দিক রয়েছে। আমি বুঝি সেটি। কিন্তু ওই যে সময়ের দাবি। কিছু সময় সব কিছু ছেড়ে তুমি মানুষ হিসাবে কেমন তা প্রকাশ করতে হয়। যে কোনো রাজনৈতিক রঙের ঊর্ধ্বে এটা।
সব কিছুর রাজনীতিকরণ হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিও তা-ই। আপনি ভারসাম্য রাখেন কীভাবে? উত্তরে অভিনেত্রী বলেন, দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক শিল্পী রাজনীতি করেন। তবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এই ট্রেন্ড ছিল না। সে ক্ষেত্রে অসুবিধা একটু হয়েছে। কারণ যেসব শিল্পী রাজনীতির ময়দানে যোগ দিয়েছেন, তারা শিল্পীসত্তার বাইরে বেরিয়ে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন। দুটো সত্তা তো ভিন্ন রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ছবির মান নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা করে এর পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। এর জন্য সৃষ্টিশীল মনের প্রয়োজন। এর অভাব ঘটছে। আমি কোনো দিনই কাউকে তোয়াজ করে চলতে পারব না। সবাই জানেন, আমি অ্যাকটিভিস্ট নই। আমার বার্তা, বক্তব্য, আমার রাগ, অভিমান, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ— সবই আমার শিল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তুলব। আমি এমন চরিত্রে অভিনয় করব, যা হয়তো মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে।
পাওলির জীবনে বিলাসিতার একটুও ছোঁয়া নেই—এমন প্রশ্নের উত্তরে অভিনেত্রী বলেন, না। আমি এমনকি প্রয়োজন না হলে ফোনও খুব একটা বদলাই না। ছয় মাস অন্তর নতুন দামি ফোন বা আইপ্যাড চাই না আমার। বড় গাড়ি, বড় জায়গা, বড় বাড়ির চাহিদা নেই আমার।
তিনি বলেন, আমি সুতির শাড়ি পরতে ভালোবাসি। জিনিসের মূল্য বড় কথা নয় আমার কাছে। আমি জিনিসপত্র সহজে ফেলেও দিতে পারি না। দেড় বছর আগে শিকাগোয় যে পানির বোতল কিনেছিলাম, সেই পানির বোতল আমি সঙ্গে করে এনেছি, এখনো ব্যবহার করি বাড়িতে। বোতলের অবস্থা দেখুন, দেহ রাখবে যে কোনো দিন। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো আমার ভালো লাগে। মুম্বাইয়ে গেলে অটোয় চড়ে ঘুরি। আমি তো চাইলেই আমার গাড়িটা নিয়ে যেতে পারি। স্কুল-কলেজে হাত খরচ বাঁচানোর জন্য ট্রামে চড়ে যাতায়াত করতাম।
অভিনয়জীবন আর অর্জুন দেবের সঙ্গে সংসার— দুদিক সামাল দিতে পারেন সহজে? উত্তরে পাওলি বলেন, আমি বিয়ের সময় ওকে বলেছিলাম— আমার প্রথম ভালোবাসা সিনেমা, আর ওর প্রথম ভালোবাসা গলফ। আমাকে অর্জুন বলেছিল—আমি কোনো আসবাবকে বিয়ে করতে চাই না। আমার মা বরাবর বলে এসেছেন, নিজের আর্থিক নিরাপত্তার দিকটি সুনিশ্চিত করে তবেই কোনো মেয়ের বিয়ে করা উচিত।
লজ্জার সমস্ত সীমা অতিক্রম করলেন এই অভিনেত্রী, ভুলেও কারও সামনে দেখবেন না
তিনি বলেন, আমি তো অনেক পরে বিয়ে করেছি। অর্জুন তো আমার থেকে ছোট বয়সে। কোথাও ঘুরতে গিয়ে মনে হয়েছে, ওর হয়তো এই জিনিসটা পছন্দ। আমি কিন্তু ওকে কিনে দিতে পেরেছি। বাংলা ছবি করে আমি কত টাকা পাই? বাংলা ছবি কাকে কতটা দিয়েছে? কিন্তু আমি তো ওর মধ্যেই সবটা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি। যারা জানবেন, তারা জানবেন। যারা আঙুল তোলার, তারা আঙুল তুলবেন! অন্য কারও জায়গায় না দাঁড়িয়ে কারও বিচার করা উচিত নয়। কারণ তুমি জানো না, সে কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। বিচ্ছিন্নতা, স্বল্প জীবনযাপনে বিশ্বাসী আমি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।