জুমবাংলা ডেস্ক : যে মেয়েটিকে ক্যাম্পাসের সবাই চিনতো আত্মহত্যা প্রতিরোধকারী হিসেবে। সেই প্রাণোচ্ছল, প্রতিবাদী মেয়েটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে এক সহপাঠী ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। এই বিষয়টিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীই মেনে নিতে পারছেন না। তারা শুক্রবার রাত থেকে আন্দোলনের নামেন। তবে সবার মনে এখনও একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, শেষ মুহুর্তে কি হয়েছিল অবন্তিকার সঙ্গে যে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হলো তাকে?
অবন্তীকার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলেন, অবন্তিকা খুবই শক্ত মনমানসিকতার মেয়ে ছিল। ও নানাভাবে করা অপমান সে সহ্য করতে পারে নাই। শুধু অবন্তীকা নয় এর আগে আরও একটি মেয়ে আম্মানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিল সেখানেও প্রতিকার মেলেনি।
তিনি আরও বলেন, একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে আম্মানের সঙ্গে শত্রুতা হয় অবন্তীকার। সে আমরা মিউচুয়ালি মিটিয়ে নেই। কিন্তু এরপর থেকে আম্মান পিছু নেয়। অবন্তীকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করে। এটাতে ব্যর্থ হবার পর সে নানাভাবে ডিস্টার্ব করতে থাকে।
অবন্তীকার আরেক বান্ধবী বলেন, এই ঘটনার পর থেকেই উত্ত্যক্ত করা শুরু করে আম্মান। মানসিক যন্ত্রণা দিতে থাকে। ও একাধিকবার প্রক্টোরিয়াল অফিসে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পায়নি। দ্বীন ইসলাম স্যার তাকে ইগনোর করে কুরুচিপূর্ণ কথাও নাকি বলেছিল। অবন্তীকা খুব শক্ত মনমানসিকতার মেয়ে ছিল। মনের কষ্ট অন্যকে বুঝতে দিতো না। একদিন আংকেল আন্টিকে ক্যাম্পাসে দেখি। এরপর প্রশ্ন করলে জানায়, আব্বু-আম্মুকে এনেও লাভ হলো না। আম্মান ওকে অনলাইনে হেয় করে কথা বলতো, থ্রেট দিতো, বাজে ভাষায় কথা বলতো। আবার ডিবেটিং ক্লাবে সকলের সামনে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করতো। তার পরিচিতজনদের মধ্যদিয়ে ইউটিজিং করতো।
অবন্তীকার সহপাঠী ও জবির শিক্ষার্থীরা জানান, নানানভাবে অবন্তীকাকে থ্রেট করে আসছিল আম্মান। নানাভাবে করে আসছিল অপদস্ত। অবন্তীকার বাবা মারা গেছেন। এনিয়েও বেশ মানসিক চাপে ছিলেন। একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পাননি অবন্তীকা। তাদের দাবি উল্টা অবন্তীকেই পড়তে হয়েছে হয়রানির মুখে।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে অবন্তীকা এই বিষয়ে লেখেন- আম্মান আমাকে সেক্সুয়ালি এবিউজ কমেন্ট করায় আমি তার প্রতিবাদ করলে আমাকে দেখে নেয়ার জন্য দ্বীন ইসলামের শরণাপন্ন করায়। এরপর তিনি লেখেন- দ্বীন ইসলাম আমাকে প্রক্টর অফিসে ডেকে নারী জাতীয় গালিগালাজ করে। তিনি উল্লেখ করেন তাকে ৭ বার প্রক্টর অফিসে ডাকা হয়। আরেক অংশে অবন্তীকা বলেন- দ্বীন ইসলাম তাকে ডেকে নিয়ে … তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলসোস কোনো?
সহপাঠীদের দাবি, আম্মানের সঙ্গে অবন্তীকার প্রথম বিবাদ বাধে দুই বছর আগে। শুক্রবার রাতে অভিযুক্ত আম্মান এক ফেসবুক পোস্টে তা খোলাসা করেন। এতে বলা হয়, ২০২২ সালে একটি ফেইক আইডি থেকে আমাদের ১৪ জন শিক্ষার্থীর নামে গুজব ছড়ানো হয়। এতে অবন্তীকার নামও ছিল। এরপর আমি সবাইকে নিয়ে কোতোয়ালি থানায় যাই। সেখানে অবন্তীকা নিজেও উপস্থিত থেকে থানায় জিডি করেন। এরপর অবন্তীকা ভুল স্বীকার করলে আমরা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেন।
শুক্রবার অবন্তীকা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের এক অংশে লেখেন- “আমার ওপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এত ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে।
আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম। এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। পোস্টের শুরুতে তিনি লেখেন- আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। ফেসবুকে এই পোস্ট দেবার পর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের এই শিক্ষার্থী।
গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ‘কনসার্ট ফর জহির’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অবন্তীকা। সেখানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে নানা সচেতনামূলক কথা বলেন তিনি। এরপর তিনি ছিলেন নিজ বাড়ি কুমিল্লায়। এর আগে ১৯শে ফেব্রুয়ারি অবন্তীকাদের ব্যাচের একটি ব্যক্তিগত ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে দেখা যায়, আম্মান অবন্তীকাকে শাসিয়ে ম্যাসেজে লিখছেন- ফারদার এই ধরনের টেক্সট এই জাতীয় গ্রুপে আসলে ভালো হবে না। মেডেল গলায় ঝুলিয়ে দিবোনি। এর রিপ্লেতে অবন্তীকা লেখেন- কিছু বাদ রাখচো নাকি থ্রেট দিচ্ছো যে? রিপ্লেতে আম্মান লেখেন- এখন পর্যন্ত খুব সসম্মানে আছিস। এখান থেকে বের হয়ে যা। গায়ে পাড়া দিয়ে কোনো কিছু খাড়া করলে গাড়া মুরদা তুলে কাউকে ধুতে সময় বেশি নিবোনা।”
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ঘটনাটি অনেক পুরনো হওয়ায় এটি জানা ছিল না এবং সাম্প্রতিককালে অবন্তীকা এমন কোনো অভিযোগও করেনি। তারপরেও পুরনো ফাইল দেখে মনে হচ্ছে যে মানসিক চাপটা সে নিতে পারেনি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
এই ঘটনায় পরপরই আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার ও দ্বীন ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একইসঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ঘটনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটামের মধ্যে গতকাল রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।