ফিলিস্তিনে ইসরায়েল শুধু মানুষ নয়, হত্যা করছে জলপাইগাছও। ফিলিস্তিনিদের বিশ্বাস আর অস্তিত্বের অংশ জলপাই নিয়ে বিভিন্ন সূত্রের সহায়তায় লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র
আরব বিশ্বে বছরের প্রথম বৃষ্টিকে মনে করা হয় ‘আল্লাহর অশেষ রহমত’ হিসেবে। কারণ এর পরপরই শুরু হয় জলপাই সংগ্রহ। বৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত সূর্যতাপ আর রুক্ষ আবহাওয়ায় অন্যসব গাছ পাতা ঝরে ন্যাড়া হয়ে যায়। একমাত্র জলপাইগাছ দাঁড়িয়ে থাকে তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে। জলপাইয়ের ডালে ডালে তখন ঝুলতে থাকে সবুজাভ আশা, স্বপ্ন আর লড়াইয়ের প্রতীক। এ জলপাই সংগ্রহ আরবদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবারের সবাই তখন একসঙ্গে জলপাই কুড়াতে থাকে। যা তাদের ঐতিহ্য, নিষ্ঠা, পরিশ্রম আর একাত্ম হওয়ার উৎসবে পরিণত হয়।
অস্তিত্বের অংশ
একটি জলপাইগাছ বেঁচে থাকে শতবর্ষ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ফিলিস্তিনিরা সে জন্য মনে করে জলপাই তাদের জন্মভূমির নিশানা, তাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানকার কবিদের অন্যতম আগ্রহের বিষয় এ জলপাই। তারা ইসরায়েলের নৃশংস দখলদারিত্বের পটভূমিতে স্বদেশের জন্য ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছেন জলপাইগাছে।
বিখ্যাত ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ জলপাই গাছকে মূর্ত করেছেন একজন নারী হিসেবে যিনি ‘কাঁদেনও না হাসেনও না’ এবং যিনি ‘ঝড়ের সময় তার পাতা ছিঁড়ে নিতে দেন না।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা এখানে মরব এখানে শেষ সীমানায় এসে।/এখানে এবং এখানে আমাদের রক্ত জন্ম দেবে জলপাইগাছ’।
ফিলিস্তিনিরা বলেন, গত ৭৫ বছর ধরে তাদের জলপাই গাছগুলো ইসরায়েলের সৃষ্ট সমস্ত ভয়াবহতার মূল সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েল অন্তত আট লাখ জলপাইগাছ উপড়ে ফেলেছে। আলজাজিরা জানাচ্ছে, জাতিসংঘের মতে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের পাঁচ হাজারের বেশি জলপাইগাছ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে একদিনে ইসরায়েলি বাহিনী ৯০০ জলপাই এবং এপ্রিকটের চারা উপড়ে ফেলে। এ ছাড়া তারা নাবলুসের উত্তরে সেবাস্তিয়া গ্রামে জলপাই চুরি করে।
পৃথিবীর সেরা!
বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর বিবেচনায় জলপাই তেলের ব্যবহারকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। কারণ অন্য ভোজ্য তেল উৎপাদনে তাপের ব্যবহার হলেও জলপাইয়ের ক্ষেত্রে তা কম হয়। যে কারণে ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে জলপাই তেলের চাহিদা বেশি। অভিজাতরা সবচেয়ে ভালো জলপাই তেল খুঁজে বের করেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর মতে, সবচেয়ে ভালো জলপাইয়ের তেল হয় রামেহ এলাকায়।
এই রামেহ এখন ইসরায়েলের দখলে। যেখানে একসময় স্বাধীনভাবে বাস করত ফিলিস্তিনিরা। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল এ ভূমির দখল নেয়। তবে এখনো সেখানকার কৃষকরা জলপাই চাষ করে। আর তা থেকে তেল উৎপাদন করে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই এলাকার জলপাই তেল দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনের সেরা। শুধু ফিলিস্তিন না, আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চলে রয়েছে এর খ্যাতি। জলপাই তেল ওই এলাকার পরিচয়। উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের এ তেলের সুবাস জলপাই গাছের চারপাশে বেড়ে ওঠা বুনো ঘাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। মানুষ বলে এ তেল অনেকটা ‘ঘিয়ের মতো’।
যদিও দক্ষিণ স্পেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইতালি বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের বৃহত্তম জলপাই তেল উৎপাদনকারী অঞ্চল। তবে সেরা হলো গ্যালিল সাগরের চারপাশের জমিতে বেড়ে ওঠা জলপাইয়ের তেল। যেখানে হায়দার পর্বতের ঢালে রামেহ এলাকায় গজিয়ে উঠেছিল একসময়ের বিশ্বের অন্যতম মনোরম জলপাই বন। গবেষণায় জানা যায়, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম জলপাই চাষের স্থান। যার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ।
ওই এলাকার জলপাই তেল বিষয়ে ব্যবহারকারীদের মত, ‘আপনার হয়তো মনে হবে পৃথিবীর অমুক জলপাই তেলই সেরা। কিন্তু রামেহ’র জলপাই তেল মসৃণ এবং পোড়া নয়। এর গন্ধ তীব্র তবে খেতে মিষ্টি।’
এখনো প্রায় দুই হাজার একর এলাকায় শতাব্দী প্রাচীন জলপাইগাছ রামেহকে চারদিকে ঘিরে রেখেছে।
ভালোবাসার একটি গল্প
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংস হামলা আবার শুরু হয়। ফেসবুকে অনেকে ইসরায়েলের অমানবিক আচরণের নিন্দা করেন। ফিলিস্তিনের পক্ষে লিখতে থাকেন। তেমন একটি পুরনো পোস্ট ভাইরাল হতে শুরু করে। পোস্টটি লিখেছেন ডিমা সিলাওয়ি। জয়তুন ডটকম-এ তার পরিচয় লেখা হয়েছে একজন ফিলিস্তিন-আমেরিকান নারী। ফেসবুকে লেখাটি প্রকাশ করা হয় ২০১৮ সালে।
তার লেখাটি অনুবাদ করেছেন গবেষক ও উদ্ভাবক মাহবুব সুমন। ডিমা সিলাওয়ি লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় আমি বুঝতেই পারিনি, কেন আমার বাবা-মা শুধু ফিলিস্তিন থেকে আমদানি করা জলপাই তেল ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেন। লম্বা পথ ও সময় পাড়ি দিয়ে পুরনো ব্যবহৃত কন্টেইনারে এমনভাবে এই তেল আমাদের হাতে আসত যা মোটেই সস্তা বা আরামদায়ক ছিল না। আমি মনে করতাম, তারা দেশে পরিচিত বা অপরিচিত কোনো পরিবারকে যদি সাহায্যই করতে চান, তাহলে টাকা পাঠালেই হয়, তাতে তাদেরও উপকার হয় আমরাও অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাই। আমরা কাছাকাছি দোকান থেকে সুন্দর ঝকঝকে দেখতে জলপাই তেল কিনেই ব্যবহার করতে পারি। তবু আমরা শুধু ফিলিস্তিন থেকে আনা জলপাই তেলই ব্যবহার করতাম। আমাদের পরিবারে ফিলিস্তিনি জলপাই তেলের কোনো বিকল্প ছিল না।’
‘বড় হয়ে ছাত্র অবস্থায় আমি যখন খণ্ডকালীন চাকরি করছিলাম, তখন জলপাই তেল নিয়ে টুকটাক কাজ করার সুযোগ হয়। স্পেন, ইতালি এবং অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা জলপাই তেলের বিস্তারিত ছিল আমার নখদর্পণে। আমি জানতাম কোনটা ভালো, কোনটা অনেক দামি। কড়া স্বাদ থেকে আমি বুঝতে পারতাম কোনটা এক্সট্রা ভার্জিন তেল বা কোনটা না। এমপ্লয়ি ডিসকাউন্ট ব্যবহার করে দামি জলপাই তেলের একটা জার আমি রান্নার জন্য নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু ব্যবহার করতে পারিনি। ঠিক জানি না কেন, তবে কাজটা করতে একদম মনে সায় দিচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, এটা আমার বাবা-মায়ের প্রতি অসম্মান দেখানো হবে। তবে ব্যবহার করলে ফিলিস্তিনি জলপাই তেলই ব্যবহার করতে হবে এমনও মনে হয়নি আমার কাছে’।
‘শেষে এক বছর জলপাই তোলার মৌসুমে ফিলিস্তিনে থাকার পর আমার ধারণা বদলে গেল। ফিলিস্তিনে জলপাই তোলার সময়টা অত্যন্ত পবিত্র মৌসুম হিসেবে দেখা হয়। কোন আবহাওয়ায় জলপাই ভালো থাকবে না খারাপ থাকবে তার ওপর ভিত্তি করে ফিলিস্তিনিরা সেই আবহাওয়াকে ভালো বা খারাপ বলেন।
জলপাইগাছ ফিলিস্তিনিদের কাছে বিশেষ কিছু। গাছ থেকে জলপাই পাড়া বা গাছ সম্পর্কিত অন্যান্য কাজ সম্মানের সঙ্গে করার বিষয়ে অলিখিত কিছু নিয়ম-কানুনও আছে। প্রত্যেকে যে অফিসেই কাজ করুক না কেন, শুধু জলপাই পাড়ার জন্য একদিন ছুটি দেওয়া হয় তাদের। এ মৌসুমে গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় লোকজনকে ফোনে আত্মীয়-স্বজনকে তাদের জন্য কোকা-কোলা বা কোনো ড্রিংকসের বোতলে তুলে রাখা জলপাই তেল নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে শোনা যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা এখানে। হঠাৎ হয়তো দেখা যাবে কেউ একজন তার শ্যালককে বৈয়ামে ঠাসাঠাসি করে রাখা জলপাই দেওয়ার জন্য রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়েছেন’।
‘নাবলুসে নাব্লুসি সাবান কারখানার মালিককে গর্ব করে বলতে শুনেছি, তিনি কতটা যাচাই-বাছাই করে তার জলপাই তেল সংগ্রহ করেছেন। এক কাপ জলপাই তেল দিয়ে তিনি আমাকে এর গন্ধ শুকতে বলেন। তীব্র গন্ধ আমার মস্তিষ্কের সমস্ত কোষে তেলের উৎকৃষ্টতার জানান দেয়, প্রশংসায় আমার দ্বিধাগ্রস্ত প্রবাসী চেহারার অভিব্যক্তি বদলাতে শুরু করলে তিনি বিজয়ীর হাসি হাসতে থাকেন। দেখলাম এখানে অনেক খাবারেরই অপরিহার্য উপাদান হলো জলপাই তেল। মজা করে বলতাম, ‘ফিলিস্তিনিরা পানির চেয়ে জলপাই তেল বেশি খায়’, শুনে তারা সম্মতির বাঁকা হাসি দিতেন।এখানে জলপাই তেল সত্যিই একটা অপরিহার্য দৈনন্দিন আচার।’
‘তাজা থাকার সময় জলপাইয়ের রঙে তাদের মন রঙিন হয়, আনচান করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেনের প্রতিক্রিয়ায় এর কতরকম পরিবর্তন হবে তাও আমাকে তারা মনে করিয়ে দিতেন। কোনোকিছু ছাড়া শুধু তাজা জলপাই তেলে রুটি ডুবিয়ে তারা এত মজা করে খান যেন এর চেয়ে মজাদার কিছু হয় না। জলপাই তোলার মৌসুমে যে কয়টা মধ্যাহ্ন ভোজনের দাওয়াত পেয়েছিলাম, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যে, তা ছিল আমার আমন্ত্রণকারীদের জন্য জলপাই তেল দিয়ে সাখান (ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি খাবার) রান্না কেমন হলো তা দেখানোর অসিলা।’
‘ইসরায়েলি সৈন্যরা কেন জলপাইগাছ পোড়ায় তার মনস্তত্ত্ব আমি এখন গভীরভাবে বুঝি। কারণ জলপাইগাছ হারালে ফিলিস্তিনিরা এমনভাবে কাঁদেন যেন অতি প্রিয়জন কাউকে হারিয়েছেন। তাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য এবং মানসিকভাবে ভেঙেচুরে দেওয়ার জন্যই ইসরায়েলি সৈন্যরা কাজটা করে। যেখানেই থাকেন না কেন, যদি সম্ভব হয় ফিলিস্তিনি জলপাই তেল কিনুন। আপনার পূর্বপুরুষরা হয়তো তাই চাইতেন।’
তবু মাথা নোয়াবার নয়
ফিলিস্তিনিরা কিছুতে তাদের জলপাইগাছ ছাড়বে না। তারা জলপাই থেকে তেল উৎপাদনের আদি পদ্ধতিও ছাড়তে নারাজ। যে কারণে দেখা যায় গাজায় আধুনিক তেল উৎপাদনকারী যন্ত্রের সঙ্গে পুরনো আমলের পাথর দিয়ে তৈরি চাপ দেওয়ার যন্ত্রও ব্যবহার হচ্ছে। গাজাবাসী মনে করে তাদের ঐতিহ্য ওই যন্ত্র। তাদের মতে, ওই যন্ত্রেই সবচেয়ে ভালো মানের জলপাই তেল উৎপাদন হয়। ইসরায়েলের ক্রমাগত দখলদারি, হত্যাযজ্ঞের পরও তারা ছাড়বে না জলপাইয়ের অধিকার কিংবা নিজস্ব তেল উৎপাদন পদ্ধতি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।