জাহাঙ্গীর আলম : পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মির্জা, কন্যা ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জারা জেরিন বিনতে বেনজীরের সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের আদেশের পর এবার বেনজিরের স্ত্রী ও মেয়ের ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ক্রোকের আদেশ দেওয়া চারটি ফ্ল্যাট ঢাকার গুলশানে অবস্থিত র্যানকন আইকন টাওয়ারে। চারটি ফ্ল্যাটের দলিল মূল্য ধরা হয়েছে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
এসব ফ্ল্যাটের তিনটি রয়েছে তার স্ত্রী জীশান মির্জার নামে। স্ত্রীর নামে ভবনটির ১৩ ও ১৪ তালায় থাকা তিনটি ফ্ল্যাটের দলিলমূল্য ১ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া মেয়ে জারা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে ভবনটির ১৪ তলায় ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দলিলমূল্যের একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে জব্দের আদেশের তালিকায়।
এদিকে দুইদিনে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মির্জা ও তিন কন্যার ১৯৮ একর জমি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। যার দলিলমূল্য ২০ কোটি ৭১ লাখ ৯ হাজার টাকা। এছাড়া বেনজীরের পরিবারের ৩৮টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ এবং পরিবারের মালিকানার কোম্পানিও ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সব মিলিয়ে অ্যাকাউন্ট এবং কোম্পানি বাদেও দুইদিনে বেনজীরের পরিবারের প্রায় ২৩ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ও রোববার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পতি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন।
রোববার দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, বেনজীর ও তার পরিবারের সম্পত্তির ১১৫টি দলিল, ঢাকার চারটি ফ্ল্যাট, চারটি শতভাগ মালিকানাধীন কোম্পানি, ১৫টি আংশিক মালিকানা কোম্পানি ও চারটি বিও অ্যাকাউন্ট জব্দের জন্য দুদকের পক্ষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আবেদন করেন। আদালত তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনটি মঞ্জুর করে আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ এর বিধি ১৮ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ১৪ ধারায় এসব সম্পত্তি জব্দের আদেশ দেওয়া হয়।
ক্রোকের আদেশ দেওয়া স্থাবর সম্পত্তি
আদেশ সূত্রে জানা যায়, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের জব্দকৃত স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট। এছাড়া সাভারের মৈস্তাপাড়া মৌজার ৩ কাঠা জমিও জব্দের আদেশের আওতায় রয়েছে।
জব্দের আদেশ দেওয়া সম্পত্তির মধ্যে বিশাল পরিমাণ রয়েছে মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার ডুমুরিয়া মৌজায়। এখানে বেনজীরপত্নী জীশান মির্জার নামে থাকা ১১৩টি দলিলমূলে অর্জিত ৮৯.২৩ একর জমির দলিল জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এসব জমির দলিলমূল্য ১০ কোটি ২১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়াও মাদারীপুরের শিবচরে ঠেঙ্গামারা মৌজায় থাকা ৮.২৫ শতক জমি রয়েছে এ তালিকায়।
ফ্রিজ করা অস্থাবর সম্পত্তি
ফ্রিজের আদেশ দেওয়া বেনজীরের অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- সোনালী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখায় থাকা ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, শান্তা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে স্ত্রী জীশান মীর্জা ও মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে থাকা দুটি বিও অ্যাকাউন্ট, লঙ্কা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বেনজীর আহমেদের নামে থাকা দুটি বিও আইডি। এছাড়া ফ্রিজের আদেশ দেওয়া অস্থাবর সম্পত্তির আওতায় রয়েছে তার মালিকানাধীন চারটি কোম্পানির শতভাগ শেয়ার। সেগুলো হলো- সাভানা ন্যাচারাল পার্ক প্রাইভেট লিমিটেড, সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড, সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড ও একটি শিশির বিন্দু লিমিটেড।
এছাড়া বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে থাকা আংশিক শেয়ারসমূহ ফ্রিজের আদেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে তাদের আংশিক শেয়ারের খোঁজ মিলেছে সেগুলো হলো- নর্থ চিকস্ রংপুর লিমিটেড, নর্দার্ন বিজনেস অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, সেন্ট পিটার স্কুল অব লন্ডন লিমিটেড, স্টিলথ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বাংলা টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ডেল্টা আর্টিসানস লিমিটেড, ইস্ট ভ্যালি ডেইরি লিমিটেড, গ্রিন মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, কমিউনিটি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন, পুলিশ ট্রাস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্টস লিমিটেড, পুলিশ ট্রাস্ট সার্ভিস অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড, পুলিশ ট্রাস্ট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এবং এমএস সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভস।
দুদক ক্রোকের আবেদনে উল্লেখ করে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে দেশে-বিদেশে শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অনুসন্ধানকালে জানা যাচ্ছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ তাদের মালিকানাধীন ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন, যা করতে পারলে অত্র অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় মামলা রুজু, আদালতে চার্জশিট দাখিল, আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় হতে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। তাই, বিচার শেষে সরকারের অনুকূলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সুবিধার্থে স্থাবর সম্পত্তিসমূহ ক্রোক ও অস্থাবর সম্পত্তিসমূহ ফ্রিজ করা একান্ত প্রয়োজন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এবং ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ৮৩ দলিলের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। যার দলিলমূল্য ১০ কোটি ৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
বেনজীরের নামে সম্পত্তি রয়েছে গোপালগঞ্জ ও কক্সবাজারে। তার নামে মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৮ একর ১ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। যার বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, বেনজীর আহমেদের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তার গোপালগঞ্জের সম্পত্তির ৬৯টি দলিলের সম্পত্তি ক্রোকের জন্য দুদক আবেদন করে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক সম্পত্তিগুলো ক্রোকের নির্দেশ দেন।
সম্পতির আরও বিবরণ
বেনজীরের স্ত্রী জিশান মির্জার নিজস্ব নামে সম্পত্তি রয়েছে ৭ একর ১৬ শতাংশ। যার বাজারমূল্য ৮৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীরের জমির পরিমাণ ১৩ একর ৯১ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যার বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভের ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে সম্পত্তি আছে ৮ একর ২৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। মোট বাজারমূল্য ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
সাভানা ফার্ম প্রোডাক্টসের পক্ষে চেয়ারম্যান হিসেবে তার স্ত্রী জিশান মির্জার সম্পত্তি আছে ২৮ একর ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বাজারমূল্য ৩ কোটি ১৬ লাখ ১২ হাজার টাকা।
সাউদার্ন পার্ক রিসোর্ট অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাবের পক্ষে চেয়ারম্যান জিশান মির্জা ও স্বামী বেনজীর আহমেদ। সম্পত্তির পরিমাণ ১১ একর ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। দলিলমূল্য ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
সাভানা এগ্রো লিমিটেডের পক্ষে চেয়ারম্যান জিশান মীর্জা, স্বামী বেনজীর আহমেদ; জমির পরিমাণ ১৬ একর ৬৫ শতাংশ। মূল্য ১ কোটি ২৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা।
সাভানা ন্যাচারাল পার্ক প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে চেয়ারম্যান জিশান মীর্জা, স্বামী বেনজীর আহমেদ। জমির পরিমাণ ৪ একর ৫ শতাংশ। দলিলমূল্য ৩০ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
তিন সন্তান
ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর, জারা জেরিন বিনতে বেনজীরের যৌথ নামে সম্পত্তি রয়েছে ৩৫ শতাংশ। যার বাজারমূল্য ৩০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
তিন কন্যা ও দুই নাতি
রুহ মিজান স্নেহা, পিতা মিজানুর রহমান। মাশরুর নুতক মিজান নাফিজ, পিতা মিজানুর রহমান। তাদের নামে সম্পত্তি আছে ২৬ দশমিক ২০ শতাংশ।
উল্লেখ্য, গত ৩১ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক মহাপরিদর্শক তার স্ত্রী জিশান মির্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে বেনজীর আহমেদের দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার পাশে বিঘার পর বিঘা জমি রয়েছে। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার। পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় আছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরও ১০ বিঘা জমি। অথচ গত ৩৪ বছর ৭ মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট আয় ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকার মতো হওয়ার কথা।
এরপর গত ২২ এপ্রিল পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান, সচিবসহ চারজনকে রিটে বিবাদী করা হয়। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাউদ্দিন রিগ্যান এই রিট দায়ের করেন। সূত্র : জাগোনিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।