জুমবাংলা ডেস্ক : করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এর জেরে বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ে। এ দুই ক্ষতির রেশ কাটতে না কাটতেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে এল নিনো। ভয়ানক এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব ইতোমধ্যে মোকাবিলা করতে শুরু করেছে মানুষ। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা সর্বকালের রেকর্ড ছাপিয়ে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় তীব্র তাপদাহ চলছে। শত শত মাইল বনাঞ্চল পুড়ে যাচ্ছে দাবানলে। অন্যদিকে, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রবল বর্ষণ ও বন্যা দেখা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও।
এল নিনো সরাসরি আঘাত হানে চারটি মহাদেশে– উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ায়। এটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর তীব্রতা বেড়েছে। নানা দুর্যোগের হোতা এই এল নিনো। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত এল নিনোর প্রভাবে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য) খরা, দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে প্রবল বর্ষণ এবং মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে ঘূর্ণিঝড় দেখা দেয়।
বৈশ্বিক আবহাওয়ার এ পরিবর্তন ব্যাপকভাবে কৃষি, মৎস্য উৎপাদনসহ নানা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়ে যায়। স্প্যানিশ শব্দ ‘এল নিনো’র অর্থ ‘ছোট্ট বালক’। কিন্তু পরিহাসবাহক এ শব্দটি বিশ্বব্যাপী বড় আর্থিক ক্ষতির কারণ।
এক গবেষণার বরাত দিয়ে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, এ দুর্যোগের প্রভাব কয়েক বছর থাকতে পারে। এতে বিশ্বের ৩ থেকে ৪ লাখ কোটি ডলার লোকসান হতে পারে। কার্যত এল নিনো পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের (অস্ট্রেলিয়া থেকে পেরু উপকূলে) তাপীয় প্রবাহ। এর প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের চাপে বড় ধরনের তারতম্য সৃষ্টি হয়। দেখা দেয় খরা, অতিবৃষ্টি ও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
অস্ট্রেলিয়ায় খরা এবং পেরু ও ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূলে ব্যাপক বর্ষণের কারণে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর প্রভাব পড়ে অন্য দেশগুলোর ওপরও। দুই থেকে সাত বছরের মধ্যে এল নিনো ফিরে আসে। জুন-জুলাইয়ের দিকে শুরু হয়ে এটি স্থায়ী হয় ৯ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। এল নিনোর প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে প্রবাহিত বর্ষার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মৌসুমি বায়ু ব্যাহত হয়। এতে অনেক সময় অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। ব্যাহত হয় বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের ফসলের উৎপাদন।
এ বছরের এল নিলো শক্তিশালী হবে– এমন ভবিষ্যদ্বাণী আগেই করেছিলেন গবেষকরা। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওসিনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানায়, ২০২৩ সালের এল নিনো হবে শক্তিশালী। কারণ, তখনই মহাসাগরের তাপমাত্রা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। সর্বশেষ এল নিনো হয়েছিল ২০১৬ সালে। জার্নাল সায়েন্স প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এ বছর এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে আগামী পাঁচ বছরে ৩ লাখ কোটি ডলার আর্থিক ক্ষতি হতে পারে।
গত শনিবার বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড, মহাসাগরে উষ্ণতা ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার চলমান গতি-প্রকৃতিকে ‘নজিরবিহীন’ বলে বর্ণনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। জাতিসংঘ বলছে, ইউরোপে ভয়ানক তাপপ্রবাহে উষ্ণতার আরও রেকর্ড হতে পারে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জলবায়ু বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ড. পাউলো সেপ্পি বলেন, এল নিনোর প্রভাবে তাপপ্রবাহ এবং দেশে দেশে জ্বীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ‘বিশ্ব এখন অচেনা অঞ্চলে পরিণত হয়েছে’।
মঙ্গলবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স জানায়, চরম তাপপ্রবাহের পেছনে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন গবেষকরা। তাদের একজন রয়্যাল নেদারল্যান্ডস মেট্রোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের ইজিদাইন পিন্টো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়া ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার তাপমাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। এল নিনোর প্রভাবে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারতে বন্যা দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় চলছে তীব্র তাপদাহ। কানাডায় শত শত মাইল এলাকাজুড়ে বনাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও তীব্র তাপদাহে ভুগছেন সাধারণ মানুষ। তাপদাহে ভুগছে ইউরোপও। তীব্র গরমে ইতালির অনেক শহরে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, স্পেন, ক্রোয়েশিয়া, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ায় চলছে তাপদাহ। ইতালির বেশ কয়েকটি এলাকায় দাবানলের তীব্রতা বেড়েছে। সিসিলির পালের্মো বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছেছে দাবানল। সেখানে সোমবার তাপমাত্রা ছিল ৪৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি। এ ছাড়া মঙ্গলবার গ্রিসের ক্রিট দ্বীপে দাবানল ব্যাপকভাব ছড়িয়ে পড়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।