বিনোদন ডেস্ক : ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নারী নির্মাতার আগমন নতুন নয়। সেই স্বাধীনতার আগেই বাংলাদেশের প্রথম নারী নির্মাতা হিসেবে মনজন আরা বেগম রেবেকা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেন। অর্থাৎ, পুরুষ চিত্রপরিচালকদের আগমনের খুব বেশি দেরিতে নারী নির্মাতার পদার্পণ ঘটেনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে। তবে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছরের ইতিহাস হিসাব করলে দেখা যায়, সেই তুলনায় খুব বেশি নারী নির্মাতার আগমন ঘটেনি এখানে। প্রথম নারী নির্মাতা রেবেকার পরে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে আর যারা এসেছেন তারা জাহানারা ভূঁইয়া, সুজাতা আজিম, সুমিতা দেবী, কোহিনূর আক্তার সুচন্দা, রোজী আফসারী, কবরী, সামিয়া জামান, চয়নিকা চৌধুরী, মৌসুমী, রোজিনা, নারগিস আক্তার, রুবাইয়াত হোসেন, মাতিয়া বানু শুকু, হৃদি হক, মারিয়া তুষার, শামীম আখতার, শাহনেওয়াজ কাকলী, রওশন আরা নিপা, মেহের আফরোজ শাওন, মাহবুবা ইসলাম সুমী, প্রীতি দত্ত, ক্যাথরিন মাসুদ, জেসমিন আক্তার নদী, তানিয়া আহমেদ এবং সর্বশেষ অরুণা বিশ্বাস।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরের ইতিহাসে এই হিসাব খুবই নগণ্য। আর নারী নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি তো বলতে গেলে আরও নগণ্য। এ ক্ষেত্রে ২০০৫ সালে কিংবদন্তি চিত্রপরিচালক জহির রায়হানের স্ত্রী এবং খ্যাতিমান অভিনেত্রী কোহিনূর আক্তার চম্পা প্রথমবারের মতো নারী নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য এ পুরস্কারটি পেয়েছিলেন তিনি। সেবার এই ছবিটি ‘শ্রেষ্ঠ পরিচালক’সহ ছয়টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। ছবিটিতে প্রয়াত কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হানের জন্যও ‘মরণোত্তর’ হিসেবে ‘শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার’ এর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জোটে। তবে ১৯৭৫ থেকে ২০২২ এই ৪৮ বছরের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ইতিহাসে ওটাই ছিল সর্বপ্রথম নারী পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া। এরপর দেড় যুগ পর দ্বিতীয় নারী নির্মাতা হিসেবে ২০২২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পেলেন রুবাইয়াত হোসেন তার ‘শিমু’ চলচ্চিত্রের জন্য।
তবে এই ৪৮ বছরের ইতিহাসে কোহিনূর আক্তার সুচন্দা আর রুবাইয়াত হোসেনই নয়, নারী নির্মাতাদের মধ্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নারগিস আক্তারের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেঘলা আকাশ’ ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘যৈবতী কন্যার মন’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে দু’টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায়। নির্মাতা সামিয়া জামানের ‘রানী কুঠির বাকি ইতিহাস’ চলচ্চিত্রটিও দর্শক গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। আর শাহনেওয়াজ কাকলীর ‘উত্তরের সুর’। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্ব সুন্দরী’ আটটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে।
উল্লিখিত তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে নারী নির্মাতাদের হাতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বেশ ভালো ভালো পুরস্কার জুটলেও যিনি তার সমগ্র চিন্তা-ভাবনা ও মেধা খাটিয়ে ছবিটা বানালেন তার সেই অর্জনের ঝুলিতে ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে উল্লেখযোগ স্বীকৃতি নেই। ব্যক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রে নারগিস আক্তার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার অর্জন করলেও তার সমগ্র কাজের স্বীকৃতি নেই। সেক্ষেত্রে ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কোহিনূর আক্তার সুচন্দার পর রুবাইয়াত হোসেনই হলেন দ্বিতীয় পরিচালক যিনি তার সামগ্রিক কাজের স্বীকৃতি পেলেন। এদিকে আবার স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসও কম চড়াই-উতরাইয়ের নয়। এই শিল্প সবসময়ই নিষ্কণ্টকভাবে এগিয়ে গেছে এমন নয়। বিভিন্ন সময়েই পারিপার্শ্বিক বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে এই শিল্প। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই সিনেমা কখনো ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কখনো তীব্র সংকটে পড়েছে। এই ভাঙা-গড়ায় সবচেয়ে বেশি সংকট পার করতে হয়েছে নারী নির্মাতাদের। কখনো অর্থ সংকট, কখনো কলাকুশলী সংকট, কখনো সিনেমা বানানোর ইন্সট্রুমেন্ট সংকটেও পড়তে হয়েছে। সেই সঙ্গে আরও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সংকট তো আছেই।
এমন বাস্তবতার নিরিখে রুবাইয়াত হোসেন বলেন, ‘সর্বোপরি এই চলচ্চিত্র শিল্পে নারী-পুরুষের একটা দৃশ্যমান এবং আরেকটি অদৃশ্যমান বৈষম্য রয়েই গেছে। এ নিয়েই আমার আজকের এগিয়ে চলা। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় এক যুগ। নিজের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি. দেশে নারী নির্মাতা একেবারে হাতেগোনা। তার ওপর তারা নানা বৈষম্যের শিকার। আমার মনে হয়েছে, বৈষম্যের এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বেশি করে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমরা যারা আছি, তাদের সঙ্গে আরও মেয়েদের চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু তার আগে দরকার মেয়েদের চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখানো। এ ভাবনা থেকেই আমরা চালু করি সুলতানাস ড্রিমের কর্মশালা। এখানে প্রথমে অংশগ্রহণ করেন ১৬ জন নতুন নারী নির্মাতা। এ থেকে তিনজন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ শিরোনামে নির্মাণ করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।’
এবার ২০২২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জনের ক্ষেত্রে শুধু শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কারই নয়, রুবাইয়াত হোসেনের চলচ্চিত্র শিমু সর্বাধিক চারটি পুরস্কার জিতেছে।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে পোশাকশিল্পের যে ভূমিকা রয়েছে তারই পটভূমিকায় নারী পোশাক শ্রমিকদের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প বলা হয়েছে রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘শিমু’ বা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এ। ছবিটির নাম প্রথমে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ রাখা হলেও পরে নামটি পরিবর্তন করে ‘শিমু’ রাখা হয়। তবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ হিসেবেই প্রদর্শিত হচ্ছে।
রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত প্রথম ছবি মেহেরজান মুক্তি পায় ২০১১ সালে এবং দ্বিতীয় ছবি ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। ওই বছর শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার জন্য রুবাইয়াত হোসেন পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জার জন্যও পুরস্কার পায় ছবিটি।
রুবাইয়াত মূলত আন্তর্জাতিক অঙ্গনকেই টার্গেট করে তার ছবির পরিকল্পনা সাজান। সেজন্য দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির আগেই প্রদর্শিত হয়ে আসছে তার ছবি আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতে। এগুলোর মধ্যে আছে, টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসব, লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসব, ফ্রান্সের সেইন্ট জঁ দ্য-লুজ চলচ্চিত্র উৎসব (এ উৎসবে শিমু বা মেইড ইন বাংলাদেশের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নেন রিকিতা নন্দিনী শিমু), ইতালির টোরিনো বা তুরিন চলচ্চিত্র উৎসব, ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবসহ আরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে রুবাইয়াত হোসেনের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।