আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কলকাতায় এসেছেন, কিন্তু হাওড়া ব্রিজ দেখেননি, এমন বাংলাদেশি নেই বললেই চলে। কলকাতায় আসেননি, কিন্তু হাওড়া ব্রিজের নাম শোনেননি, এমন মানুষের সংখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু জানেন কি? ব্রিটিশ যে সংস্থা হাওড়া ব্রিজ বানিয়েছিল, তারা আরও একটি ঝুলন্ত সেতু বানিয়েছিল, হুবহু হাওড়া ব্রিজের আদলে। তাও কলকাতার বুকে।
কেন জানেন? শুধুমাত্র একটি মসজিদে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল হাওড়া ব্রিজের আদলে আরও একটি সেতু, জলাশয় পেরিয়ে লোকজন যেন মসজিদে যেতে পারেন। বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি বহন করে আসা মসজিদটি হলো দক্ষিণ কলকাতার লেক মসজিদ।
বাংলার ইতিহাসে এমন বহু মসজিদ আছে, যা সেভাবে প্রকাশ পায়নি। তেমনই একটি লেক মসজিদ। মসজিদের কারণেই ওই ঝুলন্ত সেতুটি নির্মাণ করা হয় কলকাতার বুকে। অথচ স্থানীয় বাসিন্দাদেরই অনেকেই এ তথ্য অজানা। এমনকি পথচলতিরাও এর সঠিক সন্ধান দিতে পারবেন না।
মধ্য কলকাতার প্রাণকেন্দ্র বলা হয় গড়ের মাঠকে। ঠিক এমনি আরেক প্রাণকেন্দ্র রয়েছে দক্ষিণ কলকাতায়। ১৯২ একরের জলাশয়, আর গাছ-গাছালিতে ভরা ঢাকুরিয়া থেকে টালিগঞ্জের একাংশ। সেই জলাশয়ের বর্তমান নাম, রবীন্দ্র সরোবর। বিশাল সেই জলাশয়ের মাঝখানে লেক মসজিদ।
১৮২৪ সালে মসজিদটি নির্মিত হয়। পরে লর্ড কার্জনের অধীনে কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট পুরো এলাকা দখল করার পর তা সুন্দর করা এবং রাস্তা নির্মাণ এবং বসবাসের জন্য এলাকার উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১১ সালে এ অঞ্চলে খনন করা হয় বিশাল জলাশয়। ৭৬ দশমিক ৭৬ হেক্টর সেই জলাশয়ের আয়তন। তার মাঝে মসজিদ। এক সময় নৌকা করে মুসল্লিরা নামাজ পড়তে যেতেন।
পরে নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বার্ন অ্যান্ড কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি সেতুর, যাতে মুসলমানরা পশ্চিম পাশে অবস্থিত মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারেন। এ বার্ন কোম্পানি, কলকাতা ও হাওড়াকে জুড়ে দিতে তৈরি করেছিল ঝুলন্ত ব্রিজ। যাকে মানুষ চেনে হাওড়া ব্রিজ নামে। বর্তমানে সেতুটির নাম রবীন্দ্র সেতু। সেই ব্রিটিশ সংস্থা ১৯২৬ সালে হুবহু হাওড়া ব্রিজের আদলে তৈরি করে মসজিদের জন্য একটি সেতু।
প্রতিদিন ৩০-৪০ জন রোজাদার মসজিদে ইফতার করেন। মসজিদটির ইমাম একজন বিহারি। মহ. নওশাদ ১২ বছর ধরে লেক মসজিদের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ইফতারির আয়োজন বাড়ে। তবে ৭০-৮০ জনের বেশি নয়।
রবিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, উত্তরপ্রদেশ থেকে ২০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এসেছিলেন এ মসজিদে। উত্তরপ্রদেশ হলো সেই রাজ্য, যেখানে সম্প্রতি রাম মন্দির নির্মাণ হয়েছে। সেখান থেকে আসা লোকেরা মসজিদ প্রাঙ্গণে বসে প্রার্থনা করেন। তারপর নিজেদের মতো মসজিদে বসেই ফলাহার করেন। পাশে দাঁড়িয়ে রোজদাররা মুসল্লিরা এগিয়ে দেন পানি, এটা ওটা।
তারা জানান, উত্তরপ্রদেশের উন্নাও মফস্বল থেকে তারা প্রতিবছর রমজানের নানা সময়ে আসেন। কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন এই মসজিদ তাদের কাছে এক ধরনের বিশ্বাস। যেকোনো বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের আগে রোগী অথবা তার পরিবারের সদস্যরা এ মসজিদে এসে প্রার্থনা করেন। তাতে তারা নাকি উপকারও পেয়েছেন। এ কারণে প্রথামতো বছরের পর বছর ধরে তারা আসছেন। তাদের বিশ্বাস, হয়তো না এলে, বড় কোনো বিপদ হতে পারে। সে বিশ্বাসেই এ সময়ে তারা আসেন।
রাজকিশোর নামে একজন, তার স্ত্রী লক্ষ্মীরানির দিকে আঙুলের ইশারা করে বলেন, ২০১৪ সালে বিয়ের পর স্ত্রীকে হঠাৎ বোবায় ধরে। কথা বলতে পারছিল না। অনেকেই বলেছিল, লক্ষ্মী আর কথা বলতে পারবে না। এরপর লেক মসজিদের সন্ধান পাই। এখানে এসে প্রার্থনা করি। ফিরে গিয়েই এমন একজন চিকিৎসক পেলাম, যার মাধ্যমে সে এখন কথা বলতে পারে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এমানুর রহমান বলেন, বহু বছর ধরে উত্তরপ্রদেশ, কানপুর থেকে লোকজন আসে। আরও অনেক মানুষ আসেন। আমরাও তাদের বিশ্বাসে বাধা দিই না। আর দেবো কেন, এ দরবার সবার জন্য। শুধু প্রার্থনা করার ভঙ্গিটা আলাদা।
পেশায় চিকিৎসক, শরীফের বয়স বছর ৩০ হবে। মরদেহের ময়নাতদন্ত তার পেশা। পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যুক্ত। রোববার কাজের চাপ নেই বললেই চলে। তাই আগেভাগে এসেছেন। নামাজের সঙ্গে বিশ্রাম নিচ্ছেন মসজিদে। ইফতার তখনও ঢের দেরি।
নানা গল্পে শরীফের বলেন, দেখুন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার চাইলে এই মসজিদ জলাশয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তা তারা করেননি। ফলে মসজিদ এবং সুসজ্জিত বিশালাকার জলাশয় দুটোই একসঙ্গে আছে। এতে বিশ্বাস রাখছে দুই সম্প্রদায়। আসলে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে গেলে অন্য স্থাপত্য ধ্বংস করতে হবে, এর কোনো মানে হয় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।