লাইফস্টাইল ডেস্ক : প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ২০২৪ সালে উদযাপিত আরবি ভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারিত হয়েছে ‘আরবি ভাষা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি উদ্ভাবন বাড়াতে হবে’। আজ থেকে চার দশক আগে ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণসভার ২৮তম অধিবেশনে আরবি ভাষাকে এর দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১২ সালে ইউনেসকো সেই দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস ঘোষণা করে। এরপর থেকে দিনটি ‘আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। ইংরেজি, ফ্রেন্স, চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ। বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ও প্রাচীন ভাষাগুলোর অন্যতম আরবি। তারপরও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরবি ভাষা ছিল অনেকটা উপেক্ষিত। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় আরব নেতাদের আরবি ভাষা ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। ফলে আরব বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো এ ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সোচ্চার হয়। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও মরক্কোর ভূমিকা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দীর্ঘ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের ৩১৯০ নম্বর সিদ্ধান্তে আরবি জাতিসংঘ ও তার সংশ্লিষ্ট সংস্থার দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরবি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আরবি সেমিটিক ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও বহুল প্রচলিত। সৌদি আরবের কিং সালমান গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যারাবিক ল্যাংগুয়েজের তথ্য মতে, বর্তমানে ৫০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর ২৫টি দেশের সরকারি ভাষা আরবি। গোটা বিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষাগুলোর মধ্যে আরবির অবস্থান চতুর্থ। এ ছাড়া গোটা দুনিয়ার সব মুসলিম এই ভাষায় ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান পালন করে। এমনকি প্রাচ্যের খিস্টানদের অনেক গির্জারও নির্ভরযোগ্য ভাষা হলো আরবি। আরবি ভাষায় ইহুদি ও খিস্টানদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ লেখা। আরব বিশ্বে তো বটেই, পৃথিবীর প্রায় সব আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগ আছে। পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি হওয়ায় এ ভাষা অমর, অক্ষয়।
আরবি ভাষার ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো। এই ভাষায়ই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শব্দ। আরবি ভাষার আছে কদর সারা বিশ্বে। আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় আরবির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে আধুনিক যুগে। মুসলমান ছাড়াও অসংখ্য অমুসলিম পণ্ডিত আরবি ভাষাচর্চায় তৎপর। তাদের কেউ প্রাচ্যবিদ হিসেবে খ্যাত, আবার কেউ কেউ প্রসিদ্ধ ‘মধ্যপ্রাচ্য-গবেষক’রূপে।
মধ্যযুগে ইউরোপ ছিল অন্ধকারে। অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ন্যায় আরবি সম্পর্কেও তাদের কোনো কৌতূহল ছিল না। সর্বপ্রথম যে প্রাচ্যবিদ আরবি ভাষার প্রতি মনোযোগ দেন তিনি হলেন পাদরি হার্টমোট (Harmote) . প্রথম দিকে অমুসলিম পশ্চিমাদের কাছে আরবি ভাষার গুরুত্ব ও কদর তেমন ছিল না। পরে ইসলামের জয়যাত্রা এবং মুসলমানদের সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে আরবির গুরুত্ব বেড়ে যায় অমুসলিম শিবিরে। কারণ তখন আরবিই ছিল উন্নতি ও অগ্রগতির সামাজিক বাহন।
লেখক ও ইতিহাসবিদ সার্টন (George Sarton/ ১৮৮৪–১৯৫৬) এই ঐতিহাসিক সত্যকে স্বীকার করেছেন তাঁর ‘Introduction to the History of Science’ শীর্ষক গ্রন্থে। এক জায়গায় তিনি লিখেন, ‘Most valuable of all, the most original and the most pregnant were written in Arabic. From the second half of the eight to the end of the 11th century Arabic was the scientific, progressive language of mankind. During that period, anyone wishing to be well informed, up-to-date, has to study Arabic (a large number of non-Arabic speaking people did so)।
সর্বাধিক মূল্যবান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজগুলো আরবিতে লেখা হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে একাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত আরবি ভাষাই ছিল মানবজাতির উন্নতি, প্রগতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা। সে সময় কেউ আধুনিক ভালো জ্ঞানী হতে চাইলে, তাকে আরবি পড়তে হতো। (অনারবি ভাষাভাষী লোকদের একটি বড় সংখ্যা তা-ই করেছিল।)
(Sarton, George Alfred Leon, Introduction to the History of Science, CARNEGIE INSTITUTION OF WASHINGTON: 1927, p. 17),
মোট কথা, আরবি একটি মধুর ও পবিত্র ভাষা। একই সঙ্গে আরবি বহুল প্রচলিত আন্তর্জাতিক ভাষা। উত্কর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্বের ভাষা হিসেবে বিশ্বময় পরিগণিত। অতীতের ন্যায় বর্তমান যুগেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অশেষ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য সচেতন দেশে যতটুকু না গুরুত্বারোপ করা হয় আরবিচর্চায়, ততটা গুরুত্বারোপ করা হয় না আমাদের জাতীয় অঙ্গনে।
সাভারে চলন্ত বাসে যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতি, ছুরিকাঘাতে আহত ৪
বিশ্বের অন্যতম মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজিকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেভাবে যদি আরবিচর্চা হতো এবং শিক্ষাঙ্গনে আরবি ভাষার উত্কর্ষ সাধনে গুরুত্বারোপ করা হতো তাহলে বাংলাদেশ আরবি ভাষার ঐতিহ্য লালনে রোল মডেলে পরিণত হতো। ইংরেজ প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম বেডউইল (W. Bedwell) -এর মন্তব্য দিয়ে এ নিবন্ধের ইতি টানছি। তিনি বলেন : ‘এই (আরবি) একমাত্র ধর্মীয় ভাষা, যা সুখী-সমৃদ্ধ আলজেরিয়া থেকে সুদূর চীন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বিজ্ঞান ও রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে পরিগণিত।’ (বার্নাড লুইস, তারিখু ইহতিমামিল ইংজিলিজ বিল উলুমিল আরবিয়্যা, পৃষ্ঠা-৯)।
ড. মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।