বিনোদন ডেস্ক : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ থেকে শুরু করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শোবিজের শিল্পী, নির্মাতারাও। এই সরকারের অধীনে সুন্দর একটি দেশ দেখতে চান বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন অনেক অভিনয়শিল্পী।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন অনেক শিল্পী। একদম শুরুর দিক থেকে এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সাপোর্ট করে শিল্পীদের মধ্যে রাজপথে নেমেছিলেন আজমেরী হক বাঁধন, আরশ খান, ইমরাউল রাফাত, নাঈমা তাসনিম, নীল হুরেরজাহানরা, রাকা নোশিন নাওয়াররা।
সম্মুখ সারির যোদ্ধা হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে নেমেছিলেন। এটার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল, এমন প্রশ্নে আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘শিল্পীর আগে আমি একজন মানুষ, একজন মা। অবশ্যই শিল্পী হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু তার আগে একজন মানুষ হিসেবে। যেভাবে রাষ্ট্র তার জনতার ওপরে গুলি চালাচ্ছিল নির্বিচারে তা মানুষ হিসেবে সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি যেহেতু একজন সন্তানের মা, রিয়ার মৃত্যুর কথাটা আমাকে বারবার ভাবিয়েছে। বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছে তাকে। আসলে আমরা কোথায় নিরাপদ? এই জায়গা থেকে আন্দোলনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এত বছর যে ভয়-ভীতি নিয়ে বেঁচেছিলাম, ওদের সঙ্গে মিশে ওদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই ভয়-ভীতি থেকে বের হতে পেরেছি। আরও জোরালোভাবে প্রতিবাদ করতে শিখেছি। তাদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। তাদের সাহসই আমাকে সাহস জুগিয়েছে। এ আন্দোলনে তারা যে সফলতা অর্জন করেছে এর পুরো কৃতিত্বটা আসলে ছাত্রছাত্রীদেরই। তাদের রূপরেখায় আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে জ্বলজ্বল করে উঠবে এই প্রত্যাশা।’
অভিনেতা আরশ খান বলেন, ‘সেদিনের অভিজ্ঞতা খুব ভংয়কর ছিল। যা আমি কখনো আশা করিনি। চারিদিকে প্রচুর মারামারি চলছিল। আগের দিন আবু সাঈদ মারা গেল। আবু সাঈদের ভিডিওটা দেখেই আমি রাস্তায় নেমেছিলাম। তখন ওপেন গুলি হচ্ছে। সেদিন আমি বাসা থেকে বের হই রাত দুইটাই। তখনও আবু সাঈদের সংবাদটি আমার আম্মা দেখেননি। যদি অপেক্ষা করতাম আম্মা ভিডিওগুলো দেখলে আমাকে আর বের হতে দিত না। আমি যখন বের হই মা সিচুয়েশনটা আঁচ করতে পারেন নি। সারারাত চিন্তা হচ্ছিল এরেস্ট হয়ে যাব। মারতেও পারে, গুলিও করতে পারে। আপনি যখন জানবেন, যে মিছিলটাতে যাচ্ছেন সেখানে কোনো ভুল নেই। এখানে কোনো দোষের কিছু না। আপনি সঠিক। তখন মন মানসিকতা অন্যরকম হয়ে যায়। শরীরটা অন্যরকম হয়ে যায়। শরীরে পশম দাঁড়িয়ে যায়। মনে হয় কেউ গুলি করলে করুক। তখন ভয়টা আর থাকে না। মিছিলে যাওয়ার সময় বিষয়টা ভয়ংকরভাবে উপলব্ধি করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলনে যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ঝামেলা ফেস করতে হয়েছে। সরাসরি হুমকি না দিলেও অনেকে ফোন করে সাবধানে থাকতে বলে। আমাকে দেখে নিবে বলে জানায়। এক সাংবাদিক আমাকে ফোন করে বলেছিল ভাই রাতে বাসায় থাকবেন না। নাটকের শুটিং সেটে আমাকে একজন বলেছিল তোমার নাম ১২ নাম্বারে। তুমি বোকার মত এগুলো করতে যাও কেন? তোমার দায়িত্ব তো এগুলো না। আরেকজন ফোন দিয়ে বলে এলাকাতে লিস্ট হয়েছে। এরেস্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভয় যে পাচ্ছিলাম না এমন না কিন্তু না। তবে স্বাভাবিকভাবে কেন জানি ভয়টা পেয়ে বসেনি।’
একই প্রশ্নে নাঈমা তাসনিম বলেন, ‘আবু সাঈদের সেই মর্মান্তিক মৃত্যু যখন সারা বাংলাদেশের মানুষ দেখছিল ঠিক তখনই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সকল স্কুল, কলেজ, সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। যৌক্তিক দাবিতে প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা কোনভাবেই তরুণরা মেনে নিতে পারছিল না। তখন অব্দি জনতা ওইভাবে যোগদান করেনি অর্থাৎ রাজপথে নামেনি কিন্তু জনগণের মনে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে। সরকার যত বল প্রয়োগ করছিলো ছাত্র এবং জনতা ততই ফুঁসে উঠছিলো। চারিদিকে এত তরুণ প্রাণের রক্ত দেখে আমার হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো অন্যান্য শিল্পীদের মতন। শোষক আর শোষিতের লড়াইয়ে আমাকে শোষিতের কাতারেই পাবেন, আমি ও আমার সহযোদ্ধারা গেয়ে যাবো মজলুমের গান। আমরা যার যার জায়গা থেকে সামিল হয়েছি প্রতিবাদে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন শিল্পী ঠিক তত বড় মাপের, মানুষ হিসেবে সে যত বড় মাপের। বিবেক, মূল্যবোধ, জ্ঞান এবং সাহসই মূলত মানুষকে উচ্চতায় আসীন করে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের মধ্যে থেকে এই চর্চা উঠে গিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই ভুলে গিয়েছি যে আমরা গণতন্ত্রের মুক্তির লড়াইয়ে নেমেছিলাম। আমরা নিজেরাই যদি ফ্যাসিজমের চর্চায় নিমজ্জিত থাকি তাহলে দিনশেষে পরাজয় আমাদেরই হবে। একজন শিল্পী হবেন গণ মানুষের, মানুষের কথা বলবেন, গণমানুষের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। হতাশা জনক ভাবে আমাদের দেশে সবকিছুই দলীয়করণ হয়ে গিয়েছে এই ১৬ বছরে। অথচ শিল্পীর কোনো দল হবার কথা ছিল না। একজন শিল্পীর দায়িত্ব শুধু বিনোদন দেয়া নয় বরং সময়ের সত্যকে তুলে ধরা।’
ন্যায়ের জন্য লড়াই করলেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলো। দেশ স্বাধীন হলো। একজন শিল্পী বা মানুষ হিসেবে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান, এমন প্রশ্নে আরশ খানের উত্তর, ‘ক্ষমতার পতনে একটা দেশ স্বাধীন হয় না। এটা ভুল ধারণা। দেশ স্বাধীনের পাঁচটা ধাপের একটা ধাপ পূরণ হয়েছে। বাকি চারটা ধাপও সফল করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। যখন আপনার পেটে যখন খাবার থাকে তখন অবশ্যই রান্না করবেন না। তেমনি আপনার মাথায় শিক্ষা থাকলে অশিক্ষিতের মত কাজ চাইলেও করতে পারবেন না।
সড়কে বিশাল বড় একটা পরিবর্তন দরকার। লাইসেন্স ছাড়া প্রচুর আনফিট গাড়ি চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। জনপ্রিয়তার জায়গা থেকে অনেকে ভোটে জিতে যাচ্ছে। অনেকে হেরে যাচ্ছে। এখন আর আগেকার মতন কঠিন না। এখন সবকিছু ওপেন। কোনোভাবেই যোগ্য মানুষ ছাড়া শুধু জনপ্রিয়তার জন্য কাউকে কোনো জায়গা দেয়া যাবে না।
যারা নেত্বতে আসতে চায় তাদের অবশ্যই রাজনীতি নিয়ে পড়তে হবে অথবা রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা খুবই দরকার। হুটহাট করে জনপ্রিয়তার জায়গা থেকে বা স্বজনপ্রীতির জায়গা থেকে ভোট দেওয়া যাবে না। সত্যিকারের দক্ষ মানুষগুলোকে দিতে হবে যে আসলে পারদর্শী। রাজনৈতিক নেতারা হবে সাধারণ মানুষের রোল মডেল। যদি আমেরিকার বারেক ওবামার কথা বলেন খেয়াল করবেন, সে তার দেশ নিয়ে যখন কথা বলে মিলিটারি ফরমে কথা বলে। খামখেয়ালি বক্তব্য দেয় না। জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করতে হবে। দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। প্রশাসন সেক্টরগুলো যারা দেখতেছে তাদেরকেও আইনটা মেনে চলতে হবে। ক্ষমতা পরিবর্তন করে গেলে আমাদের দেশটা পরিবর্তন হবে না।বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হলে পুরো বিষয়গুলোকে ঠিক করতে হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।