ধর্ম ডেস্ক : হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতই হলো হজে মাবরুরের প্রতিদান।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৬৫৮)
‘মাবরুর’ শব্দটি ‘বিররুন’ থেকে নির্গত, যা সৎ বা পুণ্যের অর্থে ব্যবহৃত। ‘হজে মাবরুর’ ওই হজ, যাতে কোনো ধরনের পাপ কর্মের সংমিশ্রণ নেই এবং যা অহংকার ও লৌকিকতা মুক্ত। যে হজে নিয়মমাফিক সব কিছু আদায় করা হয়, আল্লাহ তাআলার কাছে তার প্রতিদান একমাত্র জান্নাত।
হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ করে এবং তাতে লৌকিকতা বা অহংকার থাকে না, তা হবে মাকবুল হজ। ইহরাম পরিপন্থী কোনো কাজ যদি সে না করে, তবে সে এই ফজিলত অবশ্যই পাবে।
এমনকি হাদিসের শেষাংশে এ-ও বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি এ বিষয়গুলোর যথাযত মূল্যায়ন করলে সে নিষ্পাপ শিশুর মতোই ফিরে যাবে। যেন মায়ের উদর থেকে সদ্য জন্ম নিয়েছে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এ ঘরের (বাইতুল্লাহর) হজ আদায় করল, স্ত্রী সহবাস করেনি এবং অন্যায় কোনো আচরণেও জড়ায়নি, সে প্রত্যাবর্তন করবে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্যঃপ্রসূত শিশুর মতোই। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭০২)
মুসলিম শরিফের বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এই (কাবা) ঘরে (হজের উদ্দেশ্যে) আসে, অতঃপর অশ্লীল এবং দুষ্কর্মও করে না, সে এমন (নিষ্পাপ) হয়ে প্রত্যাবর্তন করে যেন তার জননী তাকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) প্রসব করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩১৬১)
পবিত্র কোরআনের ভাষায়—‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ আবশ্যক করে নেয়, সে যেন হজের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা না বলে, কোনো গুনাহ না করে এবং ঝগড়াও না।
তোমরা সত্কর্ম হিসেবে যা কিছু করো আল্লাহ তাআলা তা জানেন। আর (হজের সফরে) পথ খরচা সঙ্গে নিয়ে নিয়ো। বস্তুত তাকওয়াই উত্কৃষ্ট অবলম্বন। আর হে বুদ্ধিমানরা! তোমরা আমাকে ভয় করে চলো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৯৭)
এ আয়াতে হজের ইহরামকারীদের জন্য নিষিদ্ধ কাজকর্মের কিছু বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
ইহরাম অবস্থায় যেসব বিষয় থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য ও ওয়াজিব, তা হচ্ছে রাফাস, ফুসুক ও জিদাল। ‘রাফাস’ একটি ব্যাপক শব্দ, যাতে স্ত্রী সহবাস ও তার আনুষঙ্গিক কর্ম, স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা, এমনকি খোলাখুলিভাবে সহবাসসংক্রান্ত আলাপচারিতাও এর অন্তর্ভুক্ত। ইহরাম অবস্থায় এ সবই হারাম।
‘ফুসুক’-এর শাব্দিক অর্থ বের হওয়া বা সীমা অতিক্রম করা। কোরআনের ভাষায় নির্দেশ লঙ্ঘন বা নাফরমানি করাকে ফুসুক বলা হয়। সাধারণ অর্থে যাবতীয় পাপকেই ফুসুক বলা হয়। তাই অনেক ব্যাখ্যাতা এ স্থানে সাধারণ অর্থই নিয়েছেন। কিন্তু হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এখানে ‘ফুসুক’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘সে সকল কাজকর্ম, যা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ।’ অবস্থার বিচারে এখানে এ ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত। কারণ সাধারণ পাপ ইহরামের অবস্থায়ই শুধু নয়, সব সময়ই নিষিদ্ধ।
যেসব বিষয় প্রকৃতপক্ষে নাজায়েজ ও নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ইহরামের কারণে নিষিদ্ধ ও নাজায়েজ হয়, সেগুলো ছয়টি।
১. স্ত্রী সহবাস ও এর আনুষঙ্গিক যাবতীয় আচরণ, এমনকি খোলাখুলিভাবে সহবাসসংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা।
২. স্থলভাগের জীবজন্তু শিকার করা বা শিকারিকে বলে দেওয়া।
৩. নখ বা চুল কাটা।
৪. সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবহার। এ চারটি বিষয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য ইহরাম অবস্থায় হারাম। আরো দুটি বিষয় পুরুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
৫. সেলাই করা কাপড় পরিধান, এবং
৬. মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা। অবশ্য মুখমণ্ডল আবৃত করা স্ত্রীলোকদের জন্যও নাজায়েজ।
আলোচ্য ছয়টি বিষয়ের মধ্যে স্ত্রী সহবাস যদিও ‘ফুসুক’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত, তবু একে ‘রাফাস’ শব্দের দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে এ জন্য ব্যক্ত করা হয়েছে। ইহরাম অবস্থায় এ কাজ থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর কোনো ক্ষতিপূরণ বা বদলা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কোনো কোনো অবস্থায় এটা এত মারাত্মক যে এতে হজই বাতিল হয়ে যায়। অবশ্য অন্য কাজগুলোর কাফফারা বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আরাফায় অবস্থান শেষ হওয়ার আগে স্ত্রী সহবাস করলে হজ বাতিল হয়ে যায়। গরু বা উট দ্বারা এর কাফফারা দিলেও পরবর্তী বছর আবার হজ করতে হবে। এ জন্যই ‘রাফাস’ শব্দ ব্যবহার করে এর স্বাতন্ত্র্যতা বোঝানো হয়েছে।
‘জিদাল’ শব্দিক অর্থে একে অপরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করা। এ জন্যই বড় রকমের বিবাদকে ‘জিদাল’ বলা হয়। এ শব্দটাও ব্যাপক। কোনো কোনো মুফাসসির এ শব্দের ব্যাপক অর্থই গ্রহণ করেছেন। আবার অনেকে হজ ও ইহরামের সম্পর্কের কারণে এখানে জিদালের অর্থ করেছেন হজের সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।
সাধারণ ও ব্যাপক অর্থে ফুসুক, রাফাস ও জিদাল থেকে বারণ করা এবং এসব বিষয়কে হারাম গণ্য করার একটা কারণ এ-ও হতে পারে যে হজের সময় মানুষের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে উল্লিখিত বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার বেশি আশঙ্কা থাকে। এর কারণও আছে। দীর্ঘদিন পরিবার-পরিজন থেকে দূরে অবস্থান করতে হয়। তা ছাড়া তাওয়াফ, সাঈ, উকুফে আরাফা, মুজদালিফা ও মিনায় অবস্থান কালে যতই সতর্কতা অবলম্বন করা হোক, স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশা হয়েই থাকে। এ অবস্থায় পূর্ণ সংযম অবলম্বন করা সহজ ব্যাপার নয়।
এ জন্যই সর্বপ্রথম ‘রাফাস’-এর হারামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে এ সময় চুরি ও অন্যান্য পাপ বা অপরাধও সাধারণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে প্রচুর। সে জন্য ‘ফুসুক’ থেকে সতর্ক করা হয়েছে। এভাবে হজব্রত পালনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এমন অনেক সময় আসে, যাতে সফরসঙ্গী ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে জায়গা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাধার প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাই জিদাল তথা বিবাদ-বিসংবাদ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কোরআনের ভাষালংকারে আয়াতের শব্দগুলো ‘না’ বাচক। হজের মধ্যে এসব বিষয় শুধু নিষিদ্ধই নয়, বরং হারাম। এখানে না-সূচক শব্দ ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে হজের মধ্যে এসব বিষয়ের কোনো অবকাশ নেই। এমনকি এগুলোর কল্পনাও করা যাবে না। হজ কবুল হওয়ার আরেকটি আলামত হচ্ছে, হজ থেকে ফিরে সে আর কোনো গুনাহে লিপ্ত হবে না। কারণ হজ-পরবর্তী জীবন তার জন্য নতুন জীবন, যাতে সে সদ্য জন্মানো শিশুর মতোই নিষ্পাপ।
জনৈক বুজুর্গ বলেছেন, ‘আমি হজ থেকে ফিরে আসার পর আমার মনে একটি পাপের ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি হয়, এমতাবস্থায় এক গায়েবি শব্দে আমাকে বলা হয়, তুমি কি হজ করোনি? এ শব্দ আমার এবং সে পাপের মধ্যে একটি দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে আল্লাহ তাআলা আমাকে রক্ষা করেন।’
আল্লাহ তাআলা সব হাজিকে যথাযথভাবে হজ পালন করার তাওফিক দান করুন এবং সবাইকে ‘হজে মাবরুর’ নসিব করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।