সিপন আহমেদ : আমার সঙ্গে যাদের চলাফেরা, যারা আমাকে অনুসরণ করে, যারা আমার সহযোদ্ধা তাদেরকে আমি প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের গল্প বলি। ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণার গল্প, স্বপ্নের গল্প। তাদের সবাই আমার গল্প শুনে, আমাকে বিশ্বাস করে, সর্বপরি শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।
গণমাধ্যম প্রসঙ্গে কথা উঠলে আমি ডয়েচে ভেলের উদাহরণ দিই। উদাহরণ দিই বাংলাদেশ প্রতিদিনের। প্রথম আলোর সঙ্গে আনন্দ বাজারের তুলনামূলক ব্যাখ্যা দিই। টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের বাংলা পত্রিকা “এই সময়ের” কথাও বাদ যায় না।
ডয়েচে ভেলে সম্পর্কে যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিই, তা হলো সংবাদ মাধ্যমটি এক সময় মিশন, ভিশন এন্ড অডিয়েন্সের উল্লেখ করতো। ডিডব্লিউ লিখতো, হু আওয়ার অডিয়েন্স? এই প্রশ্নের জবাবে লিখতো “দে আর ন্যাশনালি এন্ড ইন্টারন্যাশনালি ডিসিশন মেকার”।
ত্রিশটি ভাষায় সংবাদ প্রকাশ করে ডয়েচে ভেলে। আমি মনে করি, বিবিসি বাংলা’র চেয়ে ডয়েচে ভেলের মান অনেক ভালো। ডিডব্লিউ’য়ের ‘বাংলা ভাষা’ বিভাগের সম্পাদক ছিলেন খালিদ মহিউদ্দিন। তিনি সম্প্রতি ডয়েচে ভেলে ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ঠিকানা’য় যোগ দিয়েছেন।
আবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের কর্ণধার আহমদ আকবর সোবহানের রেফারেন্স দিয়ে বলি, দেশের শীর্ষ এই শিল্পপতির ইচ্ছে ” বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে, প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাক বাংলাদেশ প্রতিদিন।”
প্রথম আলো-আনন্দ বাজার সম্পর্কে আলোচনায় উঠে আসে, “কেন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা আনন্দ বাজার? প্রথম আলো কেন দ্বিতীয়?”
“এই সময়ে” পত্রিকার প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ দিক কী? আমার মনে হয়, পৃথিবীতে একমাত্র পত্রিকা “এই সময়” যাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি তা সমাধানে মতামত জুড়ে দেয়া হয়। প্রতিবেদনের মধ্যে “এই সময়ের মত বা আমাদের মত” নামে মতামত তুলে ধরে পত্রিকাটি।
মোদ্দা কথা, তাদেরকে আমি যে বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করি, এমনকি আমিও যেটা মেনে চলার চেষ্টা করি, তা হলো ডয়েচে ভেলে ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের মতো আগে পাঠক নির্বাচন করা। আমি বা তারা যে লেখাটি লিখবে, সেই লেখার পাঠক কারা হবেন?
নির্বাচিত পাঠক যদি হয় শিক্ষিত, মার্জিত, তাহলে অবশ্যই লেখায় বাক্য গঠন, উন্নত শব্দ চয়ন, শুদ্ধ বানান ও ব্যাকরণের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ রুচিশীল পাঠক লেখা পড়েই যোগ্যতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাবেন।
তবে শিক্ষিত ও রুচিশীল পাঠকের পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে সাধারণ পাঠকের কথাও। তাদের কথা স্মরণ রেখে সবচেয়ে সহজ শব্দের ব্যবহার ও ছোট ছোট বাক্য গঠনের মাধ্যমে পাঠককে সঠিক তথ্যটি জানিয়ে দিতে হবে।
প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু সব ঘটনা আমরা সংবাদ হিসেবে তুলে ধরি না। কারণ আগে আমাদের সংবাদ, সংবাদের গুরুত্ব ও সংবাদের পাঠক নির্ধারণ করতে হয়। পাঠকের চাহিদা মোতাবেক আমরা সংবাদ পরিবেশন করি। আবার অনেকে সারাদিন অসংখ্য সংবাদ প্রকাশ করে। অর্থাৎ তারা যা দেখছে, যা শুনেছে তাই সংবাদ হিসেবে তুলে ধরছে। ওইসব সংবাদের সত্যিকার্থে পাঠক আছে কি না, পাঠক সংবাদটি পড়ছে কি না, তা ভেবে দেখেনি কখনো।
আমি তখন আলোকিত বাংলাদেশ’-এ কাজ করি। একদিন সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ আমাদের অফিসে আসলেন। পুরো অফিস ঘুরে গিয়ে দাঁড়ালেন পেজ মেকআপ রুমে। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সকলের উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন করলেন “সবচেয়ে বেশি পত্রিকা প্রকাশিত হয় কোন দেশে? কিন্তু কেউ তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় তিনি জানালেন, সবচেয়ে বেশি পত্রিকা প্রকাশিত হয় জাপানে। আবার প্রশ্ন করলেন, তাহলে এতো পত্রিকা পড়ে কারা? এবার তাঁর উত্তর, যে পত্রিকায় যার বা যে প্রতিষ্ঠানের সংবাদ প্রকাশিত হয়, সে সেই পত্রিকাটি পড়ে। তবে জাপানে কাউকে পত্রিকা কিনে পড়তে হয় না। ওইদেশে পত্রিকা দেওয়া হয় ফ্রী-তে।
ছোট্ট উদাহরণটিতে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় লুকিয়ে রয়েছে, তা কি আপনারা বুঝতে পেরেছেন? আমি বুঝিয়ে বলছি। জাপানে এতো এতো পত্রিকা প্রকাশিত হলেও কিন্তু সংবাদগুলো সব এক নয়। পত্রিকাগুলো কপি পেস্ট করে না, সকল পত্রিকায় একই সংবাদ না ছাপিয়ে নিজের সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী, নিজস্ব সংবাদকর্মীদের তৈরি প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ প্রায় একই। অর্থাৎ আমাদের দেশে অসংখ্য টেলিভিশন, পত্রিকা, অনলাইন থাকা স্বত্বেও নতুনত্ব কিছু পাবেন না। দু’একটি পত্রিকায় দু’একটা বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও অধিকাংশ গণমাধ্যমের সংবাদ প্রায় একই।
সম্প্রতি একটি টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে উঠলো সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত আটক হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য টেলিভিশন ও পত্রিকার অনলাইন ভার্সনেও খবরটি প্রকাশিত হলো প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু দেখা গেলো সাবেক ওই মন্ত্রী আটক হননি। এই হলো আমাদের গণমাধ্যম।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের মতো। এই যে এতো এতো গণমাধ্যম, এসব গণমাধ্যম যদি তাদের সংবাদকর্মীদের নিজস্ব সংবাদ প্রকাশ করতো তাহলে হয়ত বাংলাদেশ থেকে অন্যায়, অবিচার, ঘুষ, দুর্নীতি দূর হয়ে যেতো। দেশে ন্যায় বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো। কাজেই গণমাধ্যমগুলো জাপানের মতো সংবাদ প্রকাশে স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে রাষ্ট্র সংস্কার ও দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক- সিপন আহমেদ, সাংবাদিক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।