জুমবাংলা ডেস্ক : অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অশান্ত মোহাম্মদপুর। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অবৈধ মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, বাজার-ফুটপাত-প্রতিষ্ঠান দখলে নিতে মরিয়া একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। হত্যা, ছিনতাই, গুলিবিনিময় নৈমিত্তিক ঘটনা। গত দুই মাসে রীতিমতো রাজধানী ঢাকার আতঙ্কের জনপদ হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর।
পুলিশে বদলির পর নতুন যারা যোগদান করেছেন তারা মোহাম্মদপুরের অনেক অলিগলি চিনছেন না। ফলে অপরাধীরাও সহজে ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকায় পুলিশ, র্যাবের পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প।
মোহাম্মদপুরের মাদক কারবার এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে গত কয়েকদিনের বিশেষ অভিযানে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। র্যাবের দাবি, গত ৪৮ ঘণ্টায় মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
যেসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন মোহাম্মদপুরবাসী
গত ২১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে অস্ত্রের মুখে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন এক বিশ্ববিদ্যালয় তরুণী। এ ঘটনার সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ফুটেজে দেখা যায়, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক তরুণী। পেছন থেকে কয়েকজন তরুণ দৌড়ে তার পথরোধ করে। চাপাতি বের করে কথা বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওই তরুণীর ব্যাগ টানাটানি শুরু হয়। তরুণী ব্যাগটি না ছাড়ায় তার হাতে কোপ দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তরুণীর ওড়না ও কাঁধের ব্যাগ ছিনতাইকারীদের হাতে চলে যায়। সব ফেলে দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করেন ওই তরুণী।
ছিনতাইয়ের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দিনের বেলায়ও একা নারীরা ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন।
২৪ অক্টোবর মোহাম্মদপুর বসিলা ৪০ ফুট এলাকার একটি মুদি দোকানে ঢুকে ধারালো অস্ত্রের মুখে দোকানিকে জিম্মি করে দুষ্কৃতকারীরা ক্যাশের সব টাকা নিয়ে যায়। এর আগে ২০ অক্টোবর সকালে মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডে দিনদুপুরে ফিল্মি স্টাইলে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকে অস্ত্রের মুখে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে ছয় দুর্বৃত্ত। ১১ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে।
মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার বাসিন্দা খন্দকার রাফি জানান, গত ১৯ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তার মেস বাসার তিন সদস্য হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ করে পেছন থেকে ৯-১০ জন অল্প বয়সী ছেলে বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। এসময় তাদের কাছে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও পকেটে থাকা প্রায় ৯ হাজার টাকাসহ সবকিছু কেড়ে পালিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা।
মোহাম্মদপুরে বেশ কয়েকদিন ধরে চলা চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনার পর সাধারণ মানুষ রাতে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। জরুরি কাজে একা বের না হয়ে দলবদ্ধভাবে অনেকেই বের হচ্ছেন। বিশেষ করে মোহাম্মদপুরে চলাচলরত কর্মজীবী নারীরা বেশি আতঙ্কে আছেন।
চলমান অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা অর্থাৎ ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে চলমান বিশেষ অভিযান জোরদারে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানকে নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি ময়নুল ইসলাম।- পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় ঘর থেকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যার পর বের হচ্ছেন না কেউ। বের হলেও দামি মোবাইল, ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও বেশি টাকা সঙ্গে রাখছেন না তারা।
রিকশাযাত্রীদের বেশি ভয়
মোহাম্মদপুরের বেশকিছু এলাকায় রিকশাযাত্রীদের কাছ থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ, মানিব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় রিকশাযাত্রীরা আতঙ্কে রয়েছেন। অনেক সময় রিকশাচালককে থামিয়ে ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মোবাইল-মানিব্যাগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে একজন ভুক্তভোগী জানান, ১৮ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে বসিলা ৪০ ফিট এলাকায় রিকশায় করে যাওয়ার সময় কয়েকজন যুবক তাকে আটকে মোবাইল ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয়।
মোহাম্মদপুরে ২ মাসে ১০ খুন
গত ৫ আগস্টের পর থেকে শুধু মোহাম্মদপুরেই খুন হয়েছে ১০ জন। এসব খুনের নেপথ্য কারণ আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ ও বাজার দখল। প্রকাশ্যে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া, গোলাগুলি যেন এই এলাকায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বধ্যভূমি সংলগ্ন বেড়িবাঁধে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন নাসির বিশ্বাস (২৯) ও মুন্না (২২)। বিগত সরকারের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে নাসির মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগ এলাকায় আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে পরিচিত।
গত ১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিল্লাল গাজীকে। বিল্লাল স্থানীয় আকাশ নীলা ওয়েস্টার্ন হাউজিংয়ের স্টাফ ছিলেন। এ হত্যার মিশনে ছিল ৯ জন। ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে গ্রিন ভিউ হাউজিং এলাকায় বাসায় ঢুকে শাহাদাত হোসেন নামে এক যুবককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৭ অক্টোবর ভোরে মোহাম্মদপুরের বসিলায় আরাম হাউজিং এলাকায় হাত-পা বেঁধে সিএনজি অটোরিকশাচালক শাহরিয়ার আশিককে (২১) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জেনেভা ক্যাম্পেই ৫ খুন
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য ধরে রাখতে ৫ আগস্টের পর থেকে দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে। এ সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে বা মাদক বিক্রিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় খুন হয়েছে পাঁচজন। সবশেষ ১৩ বছর বয়সী সাজ্জাদ হোসেন নামে এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
এর আগে ১৬ অক্টোবর মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে নিহত হন ক্যাম্পের ৮ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ কাল্লু (৩৮)। কাল্লু স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। এ হত্যার বিচার দাবি করে তার বোন নাসরিন আখতার বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। যারা নিজেদের অবৈধ ব্যবসার জন্য আমার ভাইকে মেরেছে, তাদের কেন পুলিশ ধরে না।
বিষফোঁড়া জেনেভা ক্যাম্প
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মোহাম্মদপুর থানার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত জেনেভা ক্যাম্প। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল। জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা যেন এখন মোহাম্মদপুর এলাকার বিষফোঁড়া। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা লুট করে মাদক কারবারি ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। জেনেভা ক্যাম্পের বিভিন্ন মাদক কারবারি গ্রুপের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। বিশেষ করে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র চলে যায় জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপরাধীদের কাছে। অস্ত্র পাওয়ার পর তারা নিজেদের অধিপত্য বিস্তার করতে চুরি, ছিনতাই ও খুনের মতো নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে মোহাম্মদপুর এলাকায় নানান অপরাধমূলক কার্যক্রম বাড়ছে। অপরাধীদের কাছে মোহাম্মদপুর নিরাপদ এলাকা। কেননা অপরাধ করে এ এলাকার বিভিন্ন দিক দিয়ে সহজে পালানো যায়।
কিশোর গ্যাং
মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের কালচার বেশ পুরোনো। এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বহু আগে থেকেই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন এসব কিশোর গ্যাং সদস্যরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকতো। ক্ষমতার পালাবদলে তারা রূপ পাল্টেছে। বিগত সরকারের আমলের চাঁদা ও মাসোয়ারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিতে জড়াচ্ছে তারা।
কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী
গত ২৭ অক্টোবর দিনগত রাতে মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। অভিযানে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৪০ জনের মতো সদস্যকে ধারালো অস্ত্রসহ আটক করা হয়। আটকদের অনেকের হাতে ট্যাটু ছিল। এর মধ্যে কারও কারও হাতে ডাবল স্টার খোঁচানো ট্যাটুও দেখা যায়। একেকটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা একেক ধরনের ট্যাটু ব্যবহার করে বলেও জানায় সেনাবাহিনী।
মূলত মাদক কারবারির আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে এগুলো ঘটেছে। আমরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছি। অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গ্রেফতার হয়েছে, যারাই জড়িত থাকবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।- ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রুহুল কবির খান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।