বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। আবিষ্কার করেছিলেন আপেক্ষিকতা, একাই আমূলে বদলে দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারা। তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের প্রথম গবেষণাপত্রটি ছিল: On a Heuristic Point of View Concerning the Production and Transformation of Light. Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭ (১৯০৫), পৃষ্ঠা ১৩২-১৪৮। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন আলোর কণা ফোটনের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। আলো তরঙ্গের আকারে যেমন থাকতে পারে, তেমনি থাকতে পারে গুচ্ছ গুচ্ছ কণার শক্তির আকারে। এই ধারণা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। আলোর এ রকম গুচ্ছাকার শক্তিকে আলোর কোয়ান্টা বলা হয়। আলোর কোয়ান্টা বা ফোটনের ধারণার ওপর ভিত্তি করে আইনস্টাইন দেখান যে কোনো বস্তুর ওপর…
Author: Yousuf Parvez
বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী হয়েও সবাই একে একে ব্যর্থ হচ্ছেন! তাঁদের ব্যর্থতার কারণ এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। আসলে আইনস্টাইন যে সময় ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন মহাবিশ্বকে শাসন করা প্রাকৃতিক বল মাত্র দুটি বলে ধারণা করা হতো। সেগুলো মহাকর্ষ ও বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল। কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর একে একে উদ্ঘাটিত হলো প্রকৃতির আরও কিছু রহস্য। দেখা হলো, মহাকর্ষ আর বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলই শেষ কথা নয়, পরমাণুর গহিনে লুকিয়ে আছে আরও দুটি প্রাকৃতিক বল। সেগুলো হলো সবল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। আবার আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হতে থাকে নিত্যনতুন কণা। তাতে একটা পুরো বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছিল মৌলিক কণাপদার্থবিজ্ঞান। পদার্থের মৌলিক গাঠনিক…
শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। দিনটি ছিল ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল। মৃত্যুশয্যায় তাঁর পাওয়া গেল একটি খাতা। দেখা গেল, জীবনের শেষ সময়টুকুতেও তিনি কাজ করছিলেন সমন্বিত ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে। সেই তত্ত্বটিই আজ থিওরি অব এভরিথিং নামে পরিচিত। বিশ শতকের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী কী ভেবেছিলেন এ তত্ত্ব নিয়ে? পরিচ্ছন্ন হাতের লেখায় লাইনের পর লাইন বীজগাণিতিক হিসাব কষছেন। তবে অসুস্থতার কারণে কিছুক্ষণেই হাঁপিয়ে উঠলেন। খাতা-কলম পাশে রেখে একসময় বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। সেদিনই রাতের দিকে বিড়বিড় করে মাতৃভাষা জার্মানে কী যেন বললেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। তারপরই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় আইনস্টাইনের। মজার ব্যাপার হলো, থিওরি অব এভরিথিং শিরোনামটা বিজ্ঞানজগতে পাকাপাকি আসন…
স্ট্রি থিওরি হলো একটিমাত্র সমীকরণ, যা মহাবিশ্বের সব সূত্রকে সংক্ষেপিত করতে পারে। আইনস্টাইন তাঁর জীবনের ৩০ বছর ছুটেছিলেন থিওরি অব এভরিথিংয়ের পেছনে। তিনি এমন একটি সমীকরণ আশা করতেন, যার দৈর্ঘ্য ১ ইঞ্চির চেয়ে বড় হবে না। আর এই সমীকরণের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে চেয়েছিলেন। আমাদের কাছে মহাবিশ্বের দুটি অসাধারণ তত্ত্ব আছে। এর একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব, যেটা খুব ছোট পরিসরে কাজ করে। এর মাধ্যমে আমরা পারমাণবিক বোমা, স্মার্টফোন, কম্পিউটারসহ ইন্টারনেট পেয়েছি। এটি খুব ছোট কণাদের তত্ত্ব। আরেকটি তত্ত্ব বড় পরিসর নিয়ে কাজ করে। সেটি সাধারণ আপেক্ষিকতা, বা আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্ব। এটি গ্রহ, নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বর, মহাবিস্ফোরণ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু এ দুটি…
এর বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে। অনেকের ধারণা, বাস্তবতা আসলে সিমুলেশন বা নকল হতে পারে, অনেকটা ম্যাট্রিক্স সিনেমার মতো। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। প্রথমত নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে এবং যদি ধরে নেওয়া হয় যে আবহমণ্ডল পরমাণুর বদলে অতিক্ষুদ্র মার্বেল দিয়ে গঠিত, তাহলেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পিউটারও এই আবহমণ্ডল সিমুলেট করতে পারবে না। সেটি অনেক জটিল। সবচেয়ে ছোট যে বস্তুটি আবহাওয়া সিমুলেট করতে পারে, সেটি আমাদের স্বয়ং দৃশ্যমান আবহাওয়া। কাজেই আবহাওয়াকে সিমুলেট করা যায় না, কারণ এতে অগণিত কণা থাকে। দুর্ঘটনাক্রমে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা একে আরও কঠিন করে তুলেছে। পরমাণুর স্পিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপ, ডাউন ও পার্শ্ব থাকতে পারে। তাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যা…
যদি বিশ্বাস করেন, আমাদের ছায়াপথে পৃথিবীর মতো বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহ আছে, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে: সেসব গ্রহে কি বুদ্ধিমান প্রাণী আছে? যদি থাকে, তাহলে তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে না কেন? উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা আমাদের তুলে দিচ্ছে না কেন? আমার প্রশ্ন হলো, বনে বেড়াতে গিয়ে যদি হরিণ বা কাঠবিড়ালির সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে কি তাদের সঙ্গে আপনি কথা বলবেন? শুরুতে হরিণ ও কাঠবিড়ালির সঙ্গে হয়তো আপনি কথা বলতে চাইবেন। কিন্তু একসময় সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হবেন। কারণ আপনার কথার উত্তর দিতে পারবে না তারা। কোনো প্রস্তাবও দেবে না তারা। সে কারণে তাদের রেখেই চলে আসতে হবে। আমার ধারণা, অতি…
এক সময় পরমাণু তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না অনেক বিজ্ঞানী। রোজ দুবেলা নিয়ম করে পরমাণু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন তাঁরা। কেউ কারও কথা মানতে নারাজ। ঠিক এ সময় পরমাণুর পক্ষে তাত্ত্বিকভাবে শক্ত এক প্রমাণ হাজির করেন জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। ডেমোক্রিটাস মনে করতেন, একটা বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা পর্যায়ে আসবে, যখন বস্তুটাকে আর ভাঙা যাবে না। অর্থাৎ বস্তুটার সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যাবে। সেই কণাকেই অ্যাটম বললেন ডেমোক্রিটাস। ভারতীয় পণ্ডিতরাও প্রায় একই সময়ে এরকম অবিভাজ্য কণার নাম দেন পরমাণু। মানে পরম অণু। এখন অ্যাটমকে বাংলায় বলা হয় পরমাণু। আর এ ধারণাকে বলা হয় পরমাণু মতবাদ। এ মতবাদ অনুযায়ী, জগতের সবকিছুর মূল…
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক। নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না প্ল্যাঙ্কের। তাঁর চাওয়া ছিল, শুধু এ পর্যন্ত যা কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে তা ভালোভাবে ও গভীরভাবে বুঝতে। সেই তৃষ্ণা মেটাতে অধিকাংশ সময় পড়ালেখায় মশগুল থাকতেন তিনি। পদার্থবিদ্যার নতুন নতুন বিষয় শিখতে গিয়ে বস্তু সম্পর্কেও নতুন নতুন চিন্তা করতে শিখলেন। এ সময় তিনি পদার্থবিদ্যার তত্ত্বগুলো সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারেন, বিশেষ করে তাপগতিবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলো। তাঁর মতে, তত্ত্ব হল বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা। যেসব বিষয় দেখা যায় না, তা নিয়ে বুঝতে ও চিন্তা করার উপায় হল তত্ত্ব। এই উলপদ্ধির পর ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন প্ল্যাঙ্ক। তাঁর…
২০১৩ সালে ‘হিগস বোসন’ নিয়ে গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান যুক্তরাজ্যের পদার্থবিদ পিটার হিগস ও বেলজিয়ামের ফ্রাঙ্কোই অ্যাংলার্ট। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যুক্তরাজ্যের গবেষক পিটার হিগস ও অন্যান্য আরও কজন বিজ্ঞানী পদার্থের ভর সৃষ্টিকারী অতিক্ষুদ্র নতুন এক কণার সম্ভাবনার কথা বলেন। কণাটি ‘গড পার্টিকেল’ বা ‘ঈশ্বর কণা’ নামেও পরিচিতি। ২০২১ সালে কণাটি শনাক্ত করেন সার্নের বিজ্ঞানীরা। এক ইন্টারভিউতে পিটার হিগস বলেন, ১৯২০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে আমি কৌতূহলী ছিলাম। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের কথা উঠে এলেই বারবার তাঁর নাম ঘুরে-ফিরে আসত। এই কৌতূহল থেকেই আমি পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান (অ্যাটমিক ফিজিকস) ও কোয়ান্টাম…
যা কিছু দোলে, তা–ই দোলক, যেমন দোলনা। দোলকের মজার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যার একটি হলো, একটি দোলক একটি বিন্দুকে বারবার অতিক্রম করে, একবার ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, আরেকবার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে; এই ধরনের গতিকে দোলনগতি বলে। বিষয়টি সত্যিই ভাবার মতো, সুতার মাথায় ভারী বল না থাকলে সুতা দুলবে না। অথচ দোলকের দোলনকালে এই ভরের কোনো ভূমিকা নেই। বলটির কাজ হলো পৃথিবীর অভিকর্ষ বল অনুভব করা, যার জন্য সুতা দোল খায়। দোলনকাল পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের ওপর নির্ভর করে, যা কিনা পুরো পৃথিবীর একটি বৈশিষ্ট্য। দোলকের দোলনকাল প্রথমে পৃথিবীর পৃষ্ঠে মাপব, তারপর খাড়া ওপরের দিকে উঠতে থাকব। ঠিক যে…
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গাণিতিক কাঠামো নিয়ে গবেষণা করেই অনিশ্চয়তা নীতির সন্ধান পেয়েছেন হাইজেনবার্গ। দীর্ঘ কয়েক মাস আমেরিকায় কাটিয়ে এশিয়া ট্যুরে এলেন তিনি। জাপান ও সিঙ্গাপুর হয়ে এবার তাঁর গন্তব্য ভারতবর্ষ, তথা বাংলা। ৪ অক্টোবর ১৯২৯, জাহাজে কলকাতায় এসে নামলেন হাইজেনবার্গ। ঘটনাচক্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুও তখন কলকাতায়। সত্যেন্দ্রনাথ, কে এস কৃষ্ণাণ, ডি এম বোস, আর রাও এবং অন্যান্য পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও শিক্ষকেরা সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আকস্মিক আগমনে। কলকাতায় আসার আরেকটি কারণ অবশ্যই ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বছর তিনেক আগে রবীন্দ্রনাথের কথা তিনি প্রথম শুনেছিলেন অধ্যাপক ম্যাক্স বর্নের স্ত্রী হেডভিগের কাছে। গ্যোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হাইজেনবার্গের শিক্ষক ছিলেন বর্ন। ভারতীয় কবি তখন…
ভূতের মতো রহস্যময় বলেই নাম হয়েছে ভুতুড়ে কণা। বিজ্ঞানীরা ডাকেন নিউট্রিনো বলে। ভূতের ওজন মাপার মতোই কণাটির ওজন মাপাও অসম্ভব কঠিন কাজ। অথচ মহাবিশ্বে যেসব কণা অনেক বেশি পরিমাণ আছে তাদের মধ্যে নিউট্রিনো অন্যতম। তবে এর কোনো চার্জ বা আধান নেই। ভরও প্রায় নেই বললেই চলে। আর এ কারণে সাধারণ বস্তুর সঙ্গে এদের মিথস্ক্রিয়াও হয় না খুব একটা। প্রতিমুহূর্তে দেহের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে শত শত কোটি নিউট্রিনো কণা। সহজে শনাক্তও করা যায় না। হ্যাঁ, শনাক্ত করার কিছু উপায় আছে। এই যেমন চেরেনকভ নিউট্রিনো ডিটেক্টর। তবে এরা কাজটি করে পরোক্ষ উপায়ে। নিউট্রিনো কোনো জায়গা দিয়ে চলে যাওয়ার পর তার রেখে…
বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান যোগ দিয়েছিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টে। তাঁর মূল গবেষণার বিষয় ছিল, কীভাবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ থেকে ইউরেনিয়াম-২৩৮-কে আলাদা করা যায়। ওদিকে হুইলার তখন শিকাগো চলে গেছেন। ফার্মির সঙ্গে মিলে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর বানানোর কাজ শুরু করেছেন। হুইলারের অনুপস্থিতিতে ফাইনম্যানের থিসিসের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ইউজিন উইগনার। তিনি ফাইনম্যানকে বললেন থিসিস পেপারটা লিখে ফেলতে। পেপার লেখা শেষ হলে উইগনার নিজেই পেপারটা দেখে দিলেন। এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে রিচার্ড ফাইনম্যানের পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন হলো। ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে দেখার আগেই স্ত্রী আরলিন মারা যান। ফাইনম্যান আবারো নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজ বলতে, এ সময় তিনি কর্নেল…
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সরকার পারমাণবিক বোমা বানাতে একটি বিপুল ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ম্যানহাটান প্রজেক্ট। প্রকল্পটির প্রধান পরিচালক ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। বড় বড় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য ডাক পেয়েছেন এক তরুণ বিজ্ঞানীও। তাঁর বয়স কেবল বিশ পেরিয়েছে। উচ্ছলতার বয়স। সেই বয়সে তরুণ এই বিজ্ঞানীর ঘাড়ে চেপেছে জটিল সব গাণিতিক হিসাবনিকাশের দায়িত্ব। গুরুদায়িত্ব, বলা বাহুল্য। একটু এদিক-ওদিক হলেই হয়েছে! সামান্য ভুলের জন্যও গুনতে হতে পারে চড়া মাশুল। তরুণ যেন জাদু জানেন। দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিলেন সবকিছু। সেই সঙ্গে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আর ইউরেনিয়াম-২৩৮-কে কীভাবে আলাদা করা যায়, এ নিয়েও কাজ করলেন সফলভাবে। শুধু তাই নয়। পরবর্তীতে…
শুক্রবার, শীতের সকাল। ১৯০৫ সালের ৭ মার্চ। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। কর্মব্যস্ত লোকজন ছুটছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। যেকোনো মুহূর্তে বার্ন শহরের সিগ্লোগকা নামের ক্লক টাওয়ারের ঘণ্টা বেজে উঠবে ঢং ঢং আওয়াজে। সচকিত হয়ে উঠবেন আশপাশের লোকজন। সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরের এই ক্লক টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল সেই মধ্যযুগে। নামকরা ক্যামগ্যাছে এলাকায় সটান দাঁড়িয়ে শাসন করে চলেছে গোটা শহর। এখান থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে পুরোনো ধাঁচের একটা চারতলা বাড়ি। ঠিকানা ৪৯ ক্যামগ্যাছে। সেই বাড়ির সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নেমে এলেন এক যুবক। তাঁর এক হাতে একটা খাম। শক্ত করে আঁকড়ে ধরা। যেন মহামূল্যবান বস্তুটা কোনোভাবেই হাতছাড়া…
মাত্র তিন দিন আগে ২৬ বছর বয়সে পা দিয়েছেন আইনস্টাইন। বাবা হয়েছেন ১০ মাস আগে। ক্যামগ্যাছের ওই বাড়িতে দুই কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে স্ত্রী মেলিভা আর ছেলে হ্যান্স আলবার্টকে নিয়ে আইনস্টাইনের সংসার। টেকনিক্যাল ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন সুইস পেটেন্ট অফিসে। কারিগরি বিশেষজ্ঞ। নামটা গালভারী হলেও পদ হিসেবে তা তৃতীয় শ্রেণির। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘পেটেন্ট স্লেভ’। এটি তাঁর স্বপ্নের চাকরি নয়। মাসে যে বেতন পান, তা দিয়ে সংসারও স্বাচ্ছন্দ্যে চলে না। সে সময় পদার্থবিজ্ঞানের এক অমীমাংসিত সমস্যা ছিল ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট। বাংলায় যাকে বলে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। একদিন সেটা নজরে পড়ল আইনস্টাইনের। সমস্যাটার শুরু ১৮৮৭ সালের দিকে। সে বছর জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক হার্জ আকস্মিকভাবে…
১৯০০ সালে কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান থেকে আমূল সরে আসতে বাধ্য হন তিনি। সে জন্য অনুমান করে নেন, শক্তির পরিমাণ তরলের মতো মসৃণ বা নিরবচ্ছিন্ন নয়; বরং তা নির্দিষ্ট, বিচ্ছিন্ন প্যাকেট হিসেবে ঘটে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার মতো। প্ল্যাঙ্ক এ বিচ্ছিন্ন প্যাকেটের নাম দেন কোয়ান্টা (একবচনে কোয়ান্টাম)। শক্তির প্রতিটি কোয়ান্টাম তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। এ সমানুপাতিক ধ্রুবকটি ছিল প্রকৃতির নতুন এক ধ্রুবক, যাকে এখন বলা হয় প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। তবে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে সিরিয়াসভাবে নেননি সমসাময়িক কোনো পদার্থবিজ্ঞানী। একটি সমীকরণকে প্রতিষ্ঠিত করতে জোড়াতালি দেওয়া একটি তত্ত্ব হিসেবে মনে করতেন সবাই। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সারকথা পড়ে…
১৯২৪ সাল ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে বাঙালি জাতির এক গৌরবের বছর। শতবর্ষ আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কালজয়ী প্রবন্ধ, বোস–আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব (অনেকে এটিকে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বা পরিসংখ্যানও বলে থাকেন) প্রকাশিত হয়। কার্জন হলে বসে সত্যেন বসু পদার্থবিদ্যার অস্বস্তিকর বন্ধ্যত্বের ওপর কাজ করছিলেন। সাধারণ পরিসংখ্যান তাঁর ভালোভাবেই জানা ছিল। চিরায়ত বলবিদ্যার সাহায্যে চিরায়ত বস্তুর গতিধর্ম শ্রেণিকক্ষে পড়াতেন আর চিন্তা করতেন, সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাহায্যে কীভাবে পারমাণবিক ও উপপারমাণবিক বস্তুকণার গতিবিদ্যা ও তার ধর্মাবলির একটি কাঠামো দাঁড় করাবেন। তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় (যা পরীক্ষালব্ধ জগতেও স্বীকৃত) পারমাণবিক ও উপপারমাণবিক বস্তুকণাকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: যেসব বস্তুকণার ঘূর্ণন…
১৯৭০-এর গোড়ার দিকে হকিং কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কাজ করছিলেন। বলে রাখা ভালো যে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে কৃষ্ণগহ্বর হলো এমন কোনো মৃত তারা বা মহাবিশ্বের এমন কোনো এলাকা যেখান থেকে আলো বা অন্য কোনো কিছুই নির্গত হতে পারে না। কৃষ্ণগহ্বরের প্রচণ্ড শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র তার চারপাশের স্থানকালকে অতিমাত্রায় বাঁকিয়ে ফেলে বলেই এমনটি ঘটে। হকিং ভেবে দেখলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কণাবাদী নীতির যুগপৎ প্রয়োগ করার জন্য কৃষ্ণগহ্বর একটি মোক্ষম জায়গা। শক্তিশালী মহাকর্ষক্ষেত্রের উপস্থিতিতে কণাবাদী ক্ষেত্রতত্ত্ব কী ফল দেবে? হিসাব কষে তিনি দেখলেন যে কণাবাদী নীতির কারণে কৃষ্ণগহ্বর থেকেও সামান্য হারে আলো বা অন্য বিকিরণ নির্গত হতে পারে। আমরা একে বলি হকিং বিকিরণ। পরিমাণে…
জন ডাল্টন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দশকে একটা হাইপোথিসিস বা বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনার কথা বলেন। তিনি বলেন, একটা মৌলের পরমাণু হলো সেই মৌলের ক্ষুদ্রতম কণা, যার মধ্যে সেই মৌলের সব রাসায়নিক ধর্ম থাকে। অর্থাৎ একটা লোহার পরমাণু হলো লোহার ক্ষুদ্রতম কণা, যার মধ্যে লোহার সব রাসায়নিক ধর্ম আছে। একই কথা সোনা, রূপা, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি সব মৌলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একই মৌলের সব পরমাণু অভিন্ন, তবে বিভিন্ন মৌলের পরমাণু আলাদা। ডাল্টন একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর সাপেক্ষে বিভিন্ন মৌলের পরমাণুর ভর কত হবে, তা গণনা করেন। গণনা থেকে সিদ্ধান্তে আসেন, বিভিন্ন মৌলের পরমাণুগুলো পূর্ণ সংখ্যায় যুক্ত হয়ে একটা যৌগের অণু গঠন করে। অণু হচ্ছে…
জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ৩০০ মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায় মাত্র ২০ জন। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট। আর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সিলেটে। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে, বা বলা যায় বৈশাখে দেখা যায় বজ্রপাত। সে জন্য স্থির তড়িৎ সম্পর্কে জানতে হবে। তার আগে জানতে হবে চার্জ সম্পর্কে। নিশ্চয়ই জানেন, সব বস্তু অসংখ্য ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। এর নাম পরমাণু। প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। এর ভেতরে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। এদের ভর প্রায় সমান। প্রোটন ধনাত্মক আধানযুক্ত, আর নিউট্রন নিরপেক্ষ। মানে এর কোনো আধান বা চার্জ নেই।…
ফারেনহাইট স্কেল ব্যবহারকারীদের জন্য খুব একটা সহজবোধ্য নয়, খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্যও নয়। পানি জমে বরফ হয়ে যাওয়ার তাপমাত্রা কেন ৩২ ডিগ্রি হবে, আর গরম হয়ে ফুটতে শুরু করবে কেন ২১২ ডিগ্রিতে? এর কোনো সদুত্তর নেই। ১৭৪২ সালে সুইডেনের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস ফারেনহাইটের স্কেলকে সহজ করার ব্যবস্থা করলেন। তিনি পানির গলনাঙ্ককে ১০০ ডিগ্রি এবং স্ফুটনাঙ্ককে শূন্য ডিগ্রি ধরে একটি স্কেল চালু করলেন। এই সেলসিয়াস স্কেল সহজ হলেও কেমন যেন উল্টো মনে হলো সবার কাছে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিগ্রির পরিমাণ বাড়া উচিত। সেলসিয়াস তাঁর স্কেল ঠিক করার আগেই ১৭৪৪ সালে মারা যান মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। সেলসিয়াসের মৃত্যুর পর উদ্ভিদবিজ্ঞানী…
অসীম বা ইনফিনিটি নিয়ে মানুষ হয়তো সভ্যতার শুরু থেকেই ভেবেছে। সেই ভাবনায় কতটা গণিত ছিল, তা জানা কঠিন। তবে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আদিমানব যে বিস্মিত হয়েছিল, ভেবেছিল এর বিস্তারের কথা, তা নিয়ে কোনো বিবাদ থাকার কথা নয়। মায়া সভ্যতার আদিজ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কথা বলুন, কিংবা বলুন মিশরের ফেরাউনদের পিরামিড তৈরির ভাবনার কথা—অসীমের দিকে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আজন্ম। প্রশ্ন হলো, গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসীমের ভাবনা উপস্থাপিত হলো কখন? বার্নার্ড বোলজানো নামে এক বোহেমিয়ান (প্রাচীন চেক সাম্রাজ্য) পাদ্রী প্রথম সতের শতকের শেষদিকে অসীমের গাণিতিক সংজ্ঞা দেন তাঁর প্যারাডক্স অব দ্য ইনফাইনাইট গ্রন্থে। গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসীমের অনুপস্থিতি যে প্যারাডক্স বা হেঁয়ালির জন্ম দেয়, তার…
কণাপদার্থবিজ্ঞানের বিস্ময়কর জগতে একটা নীতি আছে। চার্জের সংরক্ষণশীলতা নীতি। এ নীতিকে কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটা খুঁটি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ নীতি আমাদের বলে, ভর ও শক্তির মতো বৈদ্যুতিক চার্জেরও কোনো ধ্বংস বা সৃষ্টি নেই। মহাবিশ্বের বিপুল মিথস্ক্রিয়ার মাঝে চার্জের মোট পরিমাণ স্থির। কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হবে না। সব সময় একই থাকবে। অর্থাৎ পরিমাণটি ধ্রুব। অগণিত কণা দিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের এই মহাবিশ্ব। এর মধ্যে একটি মৌলিক কণা ইলেকট্রন। এটি একধরনের লেপটন, আরেকটু বড় পরিসরের হিসেবে ফার্মিওন, অর্থাৎ বস্তুকণা। সহজ করে বললে, বস্তুর কণাগুলোকে বলা হয় ফার্মিওন আর বলের কণাগুলোকে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর নামে ডাকা হয় বোসন। বেশির ভাগ…