রাজধানী ঢাকা, যা প্রতিনিয়ত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাগামহীন দৌরাত্ম্যে একটি মহাবিপদজনক নগরীতে পরিণত হওয়ার উপক্রম, সেই ঢাকাতেই সম্পূর্ণ বিপরীত এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এয়ারপোর্টের সীমানাঘেঁষা নিকুঞ্জ টানপাড়া এলাকা। গত ছয় মাস ধরে এই সড়কে একটিও অটোরিকশা দুর্ঘটনা ঘটেনি, যা দেশের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনে এক বিরল নজির এবং ‘জনগণের শক্তি’র এক জ্বলন্ত প্রমাণ। এই সাফল্য নিছকই একটি স্থানীয় নিরাপত্তার গল্প নয়; এটি প্রমাণ করে যে, জনগণের ইস্পাত-কঠিন ঐক্যের সামনে প্রভাবশালী মহলের চাপ, রাজনৈতিক হুমকি বা প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রতা—কোনো কিছুই টেকসই হতে পারে না।

গুলশান, বনানী, বা মিরপুরের মতো এলাকা যেখানে ট্র্যাফিক পুলিশের কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও এই ‘মরণযান’ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে নিকুঞ্জবাসীর হাতে এই সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ‘জনগণের নিরাপত্তা জনগনের হাতে’—এই দর্শনের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে।
১. ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জয়গাথা: ‘ভয় দেখিয়েও লাভ হয়নি’
নিকুঞ্জের অটোরিকশা বন্ধের এই মডেল রাতারাতি তৈরি হয়নি। এই নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের সীমাহীন যন্ত্রণা এবং অদম্য লড়াই। খিলক্ষেত টানপাড়া কল্যাণ সোসাইটির আহ্বায়ক ও সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদ ইকবাল, যিনি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী, তিনি জানান এই সফলতা অর্জন করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “নিকুঞ্জে এই ‘মরণযান’ বন্ধ করতে গিয়ে সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। রাজনৈতিক সাইনবোর্ডে অনেকেই হুমকি-ধমকি দিয়েছে; এমনকি সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভয় দেখিয়েও ব্যাটারি রিকশা চালু রাখার চেষ্টা করেছে।” কিন্তু এলাকাবাসীর সুদৃঢ় মনোবল আর ঐক্যের কারণে তারা সফল হতে পারেনি।
জাহিদ ইকবাল জোর দিয়ে বলেন, “একতা আর ঐক্য থাকলে অসম্ভবকে যে সম্ভব করা যায়, সেটি পুরো দেশবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নিকুঞ্জবাসী। এটি কেবল একটি স্থানীয় সাফল্য নয়, এটি একটি গণজাগরণের প্রমাণ।”
এই আন্দোলনের গভীর মানবিক দিকটি তুলে ধরেছেন পথচারী আশিক মোস্তফা, যার ছোট ভাই অটোরিকশা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছিলেন। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি জানান, “আমার কাছে এই বিজয় শুধু একটি এলাকার নয়, এটা হলো আমাদের মতো হাজারো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সান্ত্বনা। নিকুঞ্জের ব্যাটারিচালিত অটো রিক্সা বন্ধের মডেল দেখলে অন্য এলাকার মানুষও সাহস পাবে।”
২. জন-প্রশাসন অংশীদারিত্বের অনন্য নজির
নিকুঞ্জের এই মডেলের অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো স্থানীয় নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগ। এই মডেলের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন:
* এলাকার সচেতন নাগরিক
* স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী
* কল্যাণ সোসাইটির কর্মকর্তা
* রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ
খিলক্ষেত থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. শাহিনুর আলম মারফত জানান, প্রায় ছয় মাস আগেও নিকুঞ্জ এলাকায় অটোরিকশার কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটত। এরপর সবাই একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেন— নিকুঞ্জ এলাকায় অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করা হবে। নিকুঞ্জ মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহাদাত হোসেন এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, যে কোনো মূল্যে অটো বন্ধের এই চেতনাকে ধরে রাখতে হবে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই গণসিদ্ধান্তকে প্রশাসন সম্মান জানিয়েছে। খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাজ্জাত হোসেন বলেন, “অটোরিকশা বন্ধে নিকুঞ্জ এলাকাবাসীর এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এলাকাবাসী সম্মিলিতভাবে থানায় একাধিক অবহিতকরণ আবেদন জমা দিয়েছেন। তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা তাদের পাশে রয়েছি। এলাকাবাসীরাই এই এলাকার প্রকৃত মালিক ও অধিবাসী। তারা যতদিন এই সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে চান, ততদিন তা বহাল থাকবে।” এই প্রশাসনিক সদিচ্ছা অন্য এলাকার জন্য অনুকরণীয়।
৩. বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব:
শুধু সড়ক নিরাপত্তায় সীমাবদ্ধ নয় নিকুঞ্জের এই অটোরিকশা বন্ধের মডেল কেবল সড়ক নিরাপত্তায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাবও লক্ষ্য করা যাচ্ছে:
প্রভাবের ক্ষেত্র | ইতিবাচক পরিবর্তন:
পরিবহন ও শৃঙ্খলা: স্থানীয়দের যাতায়াতের জন্য ছোট আকারের পরিবেশবান্ধব ও বৈধ ‘ই-বাইক শেয়ারিং’ এবং ভ্যান সার্ভিস চালু হয়েছে। এতে সড়কে বিশৃঙ্খলা কমেছে। |
অর্থনৈতিক সচ্ছলতা: এলাকাটি এখন নিরাপদ হওয়ায় নতুন বাসিন্দা আসার প্রবণতা বেড়েছে। গত চার মাসে অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক সম্পত্তির মূল্য প্রায় ৫-৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। |
আইন-শৃঙ্খলা: খিলক্ষেত থানার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আগে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২-৩টি দুর্ঘটনার রিপোর্ট আসত, এখন গত পাঁচ মাসে একটিও নেই। এর ফলে পুলিশের কাজের চাপ কমেছে। |
প্যাডেল রিকশাচালকদের স্বস্তি: ব্যাটারি রিকশার কারণে জীবনধারণে প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতির মুখে পড়া প্যাডেল রিকশাচালকদের রোজগার এখন বেড়েছে এবং তারা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন। |
৪. ‘কমপ্লিট সল্যুশন’-এর পথে আলোকবর্তিকা
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরেই আজ অটোরিকশা এক সামাজিক ও প্রশাসনিক মাথাব্যথার কারণ। প্রশাসন যেখানে একে নিয়ন্ত্রণ করতে ‘শর্ট-টার্ম সল্যুশন’ খুঁজছে, সেখানে নিকুঞ্জবাসী দেখিয়ে দিল ‘কমপ্লিট সল্যুশন’-এর পথ।
নিকুঞ্জে অটো রিক্সা বন্ধের এই মডেল প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নিরাপদ সড়ক কেবল সরকারি নীতি বা প্রশাসনের কঠোরতার ওপর নির্ভর করে না; এটি নির্ভর করে নাগরিকদের সম্মিলিত ইচ্ছা, প্রতিজ্ঞা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর। নিকুঞ্জের এই বিজয় এখন দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষ, যেমন—উত্তরা মিরপুর, বাড্ডা, বা যাত্রাবাড়ীর মতো ব্যস্ত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য এক আলোকবর্তিকা। অটো বন্ধের এই ‘মডেল’ এখন কেবল একটি স্থানীয় সাফল্য নয়, এটি একটি গণজাগরণের প্রতীক—যা দেশের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনে নতুন করে এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



