আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাশিয়ার ইয়াকুৎস্ক। বিশ্বের শীতলতম শহর এটাই! -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও সেখানে দিব্যি থাকেন মানুষ! বয়সে মোটেও নবীন নয় এই শহর। ১৬৩২ সালে এর গোড়া পত্তন হয়েছিল। সাইবেরিয়ার ইয়াকুতিয়া প্রদেশের রাজধানী এই শহরের জনসংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। রীতিমতো সাড়ে তিন লাখেরও বেশি! বছরে কমপক্ষে সাত মাস, মোটামুটি অক্টোবর থেকে এপ্রিল- এই সময়টায় এখানে শৈত্যের ছোবলে নিঃশ্বাস নেয়াই যেন দায়।
তার মধ্যে অন্তত তিন মাস তাপমাত্রা পৌঁছে যায় -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবুও মানুষের জীবন এখানে রঙিন ও স্বতঃস্ফূর্ত। যদিও এর চেয়েও ঠান্ডায় বসবাসের নজির আছে। ইয়াকুৎস্কের পূর্বে ৫০০ মাইল দূরত্বে একটা গ্রামে তাপমাত্রা নেমে যায় -৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও। ঐ গ্রামের বাসিন্দারাই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু ইয়াকুৎস্কের নজিরও তা হলে হেলাফেলার নয়। সবচেয়ে বড় কথা গ্রামটিতে মেরেকেটে শ’পাঁচেক বাসিন্দা। সেখানে ইয়াকুৎস্কে লক্ষ লক্ষ মানুষ।
ভাবলে সত্য়িই অবাক লাগে। ভয়ানক ঠান্ডায় বাইরে কিছুক্ষণ থাকলে যেখানে গোঁফ-দাড়ি-ভুরু পর্যন্ত জমে সাদা হয়ে যায়, সেখানে মানুষ থাকে কী করে? ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ সবচেয়ে কনকনে অবস্থাতেও এখানে বন্ধ হয় না দোকান! একেক সময় দিনের পর দিন ধরে সূর্যের দেখা মেলে না। কখনো বা সকালে সাড়ে দশটায় সকাল হয়। তিনটার মধ্যে রাত নেমে যায়। তারপর ক্রমশ অন্ধকারে আরও ঠান্ডায় ডুবে যায় শহরটা। পাখির চোখে দেখলে মনে হবে তুষারে ঢাকা নিঃসীম প্রেতপুরী।
এরকম সময়েও দিব্যি রাস্তায় ঘুরে বেড়ান মানুষ। নতুন বছরের উপহার কিনতে দোকানে দোকানে ভিড় জমান। আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে পার্টিও করেন। অথচ সেই সময় বরফ এতটাই কঠিন হয়ে যায়, ড্রিল মেশিনেও তাকে কাটা মুশকিল! যদিও স্কুল-টুল বন্ধ থাকে। যেমন এখন রয়েছে। এটা হয়তো কয়েক মাসও চলতে পারে। তবে অনলাইনে পড়াশোনা চলে। যদিও শোনা যাচ্ছে, অভিভাবকরা নাকি দাবি তুলছেন, স্কুল খুলে দেওয়া হোক। তারা ছেলেমেয়েদের এমন প্রতিকূল আবহাওয়াতেও স্কুলে পাঠাতে রাজি!
ঠিক কতটা প্রতিকূল থাকে আবহাওয়া? সেটা একবার ভেবে দেখা দরকার। একে তো পানি বলে কিছু নেই। সব বরফ। সুতরাং তেষ্টা মেটানোর উপায়, জমাট নদী থেকে পাত্র ভর্তি বরফ নিয়ে এসে তা গরম করে গলিয়ে পান করা হয়। পথেঘাটে হাঁটার চ্যালেঞ্জটা বোধহয় আরো বেশি। বাইরে মিনিট দশেকের বেশি থাকলেই মুশকিল। শরীর ক্লান্তিতে ভরে যেতে থাকে। আর বিশ মিনিট পরেই মুখের পেশি থেকে আঙুল- সব অসাড় হয়ে যায়। তাই কোনোভাবেই সর্বোচ্চ আধঘণ্টার বেশি কেউ বাইরে থাকেন না। চারপাশে বরফের চাঁই। তবু পরিবহণ ব্যাপারটা ইয়াকুৎস্কে ভালোই। তবু এই শহরে মানুষ বাস-টাসে উঠতে খুব একটা চান না।
কারণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা মানেই শীতের তীব্র কামড় সহ্য করা। তাই বেশির ভাগ মানুষই ট্যাক্সিতে যাতায়াত করেন। আর যাদের নিজেদের গাড়ি রয়েছে, তারা গাড়িটাই মুড়ে রাখেন কম্বলে! রাস্তায় হাঁটাচলাও কম কঠিন নয়। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষদের পক্ষে। কেননা লাগাতার বরফের ফলে পথঘাট পিছল হয়ে থাকে। অসাবধান হলেই আছাড়। আর তার ফলে হাড় ভাঙা।
এখানকার বাড়িগুলোকে ঠান্ডার কামড় থেকে টিকিয়ে রাখাও কম চ্যালেঞ্জের নয়। আর তাই সেগুলো তৈরি হয় স্টিলের বুনিয়াদের উপরে। এগুলোর নিচের দিকে বায়ু চলাচল করে। যা পারমাফ্রস্টকে গলতে বাধা দেয়। তবে পানি ও গ্যাসের লাইন থাকে মাটির উপরে। এখানে বলে নেয়া দরকার পারমাফ্রস্ট কী। পারমাফ্রস্ট হচ্ছে মাটির গভীরে অবস্থিত হিমায়িত মাটির স্তর।
যাই হোক, এহেন ইয়াকুৎস্কের মানুষ কিন্তু বেঁচে থাকেন উৎসবের মেজাজে। দিন ফুরোলেই তারা জড়ো হন পাব বা নাইট ক্লাবে। সেখানে নাচ-গান-হুল্লোড়ে জীবনের ওমে তাতিয়ে রাখেন নিজেদের। শহরজুড়ে নানা রেস্তরাঁ, শপিং মল, দোকানবাজার। বাইরে তখন অন্ধকার শীতের কামড়, বরফের ধোঁয়ামাখা কুয়াশা। আকাশে জ্বলতে থাকে আদিম নক্ষত্ররা। যাকে সাইবেরিয়ার মানুষ ডাকে ‘তারার ফিসফিস’ বলে।
কিন্তু বাইরের শৈত্য কি আর কেবল বাইরে থাকে? তা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরেও। ফলে সেখানেও প্রাণধারণ করাই দায়। তাই ঘর উষ্ণ রাখতে গ্যাসোলিন, ব্যাটারি সবই কাজে লাগে। আর এর জন্য খরচ রীতিমতো আকাশছোঁয়া। শীতের দিনে গ্যাসোলিনের দাম তিনগুণ হয়ে যায়! পানীয় ও খাবারের দামও চলে যেতে থাকে হাতের বাইরে।
তবে সে নিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের ততটা মাথাব্যথা নেই। কেননা এখানে অধিকাংশ মানুষেরই পকেট গরম। আসলে সোনা, ইউরেনিয়াম ও হিরের খনির কারণে উপার্জন বেশ ভালো। তাই শহর ছেড়ে যেতে কেউই খুব একটা রাজি নন। বরং এমন প্রবল শৈত্য সত্ত্বেও জনসংখ্যা কিন্তু বাড়তির দিকেই। যা থেকে একটা জিনিস অবশ্য বোঝা যায়। শরীরের গরমের চেয়েও টাকার গরম বেশি!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।