ধর্ম ডেস্ক : রমজানে আত্মশুদ্ধি, ধর্মভীরুতায় ‘সিফাতে রব্বানি’ বা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে মুমিন বান্দা, জেগে ওঠে আল্লাহর ভালোবাসায়। রমজানে মানুষের মধ্যে সামাজিকতা বেড়ে যায়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রমজানকে উপস্থাপন করেছেন আত্মজাগরণের অনুরণনে-
‘‘মাহে রমজান এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’,
নামিবে তাহার রহমত এই ধূলির ধরার পর।
এই উপবাসী আত্মা, এই যে উপবাসী জনগণ,
চিরকাল রোজা রাখিবে না আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ।’’
কবি ফররুখ আহমদ তাঁর ‘শবে-কদর’ কবিতায় লাইলাতুল কদরকে ব্যাখ্যা করেছেন-
“এখনো সে পুণ্য রাত্রি নামে পৃথিবীতে, কিন্তু
এক অন্ধকার ছেড়ে অন্য এক আঁধারে হারায়,
ঊর্ধ্বে ইঙ্গিত আসে লক্ষ মুখে, অজস্র ধারায়;
নর্দমার কীট শুধু পাপ-পঙ্কে খোঁজে পরিত্রাণ।”
আবহমান বাংলায় আত্মজাগরণের আবাহনে তারাবি মর্যাদপূর্ণ ইবাদত হিসেবে স্বীকৃত। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নিবেদন-
‘তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ
চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লণ্ঠন-বাতি জ্বেলে।
ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।
মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সারা গাঁও
মোল্লাবাড়িতে তারাবি নামাজ হয় না এখন আর,
বুড়ো মোল্লাজি কবে মারা গেছে, সকলই অন্ধকার।
কিসে কি হইল, কি পাইয়া হায় কি আমরা হারালাম,
তারি আফসোস শিহরি শিহরি কাঁপিতেছে সারা গ্রাম।’
বাঙালি মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি তাওহিদ, রিসালাতের চেতনায় উজ্জীবিত এবং ইহ-পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত। এতে ইফতার এক ধর্মীয় আভিজাত্যপূর্ণ পবিত্র খাবার।
বাংলাদেশে মুসলিম সংস্কৃতির ধারা অত্যন্ত গতিশীল এবং বাঙালির অভিযোজন ক্ষমতা ও আত্মস্থকরণ প্রক্রিয়া খুবই উদার। ফলে বাঙালির ইফতার তালিকা দৈর্ঘ্যকে ছকে বাঁধা বা সংখ্যায় সীমিত করা দুরূহ। আফ্রো-অ্যারাবিয়ান ধারা, মোগল রসনাবিলাস, ভারতীয় রন্ধনশৈলী-সব কিছুর সমন্বয়ে বাঙালির ইফতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
বাঙালির ইফতারে খেজুরের বিকল্প নেই। কেননা, প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রিয় ফল খেজুর। সাধারণত প্রিয় নবী (সা.) সাতটি খেজুর দিয়ে নাশতা করতেন। তিনি পবিত্র রমজানে সবাইকে খেজুর ও পানি দিয়ে ইফতার করতে বলতেন। তিনি বলতেন, ‘যদি কারো ঘরে কিছু খেজুর থাকে, তবে তাকে গরিব বলা যাবে না।’
উনিশ শতকে ইফতার করাকে বলা হতো ‘রোজা খোলাই’, অর্থাত্ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোজা ভাঙা। একসময় একটু সামর্থ্যবানরা ঘরে বানানো মুড়ির বিভিন্ন পদ, মিষ্টি ও নোনতা সমুচা, কাঁচা ও ভাজা ডাল, ফল-ফলারি, পিঁয়াজু, ফুলুরি ইত্যাদি ইফতারে রাখত। ছিল ‘গোলাপি ঊখরা’ নামের মিষ্টি মেশানো বিশেষ খাবার। এ ছাড়া ভুনা চিড়া, দোভাজা, টেপি ফুলুরি, মাষকলাইয়ের বড় ডাল-বুট, বাকরখানি, নানা রকম জিলাপি, বিভিন্ন পদের কাবাব ইত্যাদি হাজির থাকত দস্তরখানায়।
ছোলামুড়ি, পিঁয়াজু বাঙালির ইফতার ঐতিহ্য। মুড়ি বাংলাদেশের মানুষের জনপ্রিয় খাবার। চাল, চালভাজা, ভাত, খই-চিড়ার জায়গায় মাখানো ছোলামুড়ি এখন বাঙালি মুসলমানের ইফতারির মূল উপকরণ। শহর কী গ্রাম, ধনী অথবা গরিব সবার ইফতার তালিকায় স্থায়ী পত্তনি করে যাচ্ছে ছোলামুড়ি, পিঁয়াজু!
ইফতার আয়োজনে মুসলিম বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার জিলাপি। দুধ, ছানা ইত্যাদি ছাড়া যে মিষ্টিগুলো আমাদের দেশে তৈরি হয়, তার মধ্যে জিলাপি অন্যতম। পবিত্র রমজানে রোজাদারের পছন্দ জিলাপি দিয়ে মিষ্টিমুখ করা। জিলাপির বাইরের অংশ শক্ত ও মুচমুচে, ভেতরটা থাকে রসে ভরা। মেঠো বাঙালির উচ্চারণ
‘জিলাপি কড়কড়া, জিলাপি মরমরা;
জিলাপির প্যাঁচে প্যাঁচে রস ভরা!’
রমজানে ধর্মভীরুতা, ধৈর্য, আত্মসংযম, মিথ্যা পরিহার, দোয়া, তাওবার মাধ্যমে সবার জীবনে প্রতিফলিত হয় জান্নাতি আবেগ ও পাপাচার বর্জিত আদর্শ আত্মজাগরণের অনুভব। তবে ঐ সব দুরাচারীর কথা ভিন্ন, যারা ইবাদতের যোগ্যতা হারিয়ে এমন-
‘জিহ্বায় তুমি মুমিন
অন্তরে তুমি মুনাফিক’- আ. কাদির জিলানি (রহ.)।
বস্তুত রমজানে গরিব দুঃখী সবার জন্য আনন্দ যেন সমান হয়, এটাই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের জিজ্ঞাসা :
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ,
নিরন্ন সেই কৃষকের ঘরে আজ আবার আসিয়াছে কি ঈদ।’
লেখক : মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।