জুমবাংলা ডেস্ক : সবচেয়ে বড় জাহাজে সৌদি আরব থেকে এলো ৮২ হাজার টন অপরিশোধিত তেল; যা গভীর সমুদ্রে স্থাপন করা সিঙ্গেল পয়েন্ট ম্যুরিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক সরবরাহ শুরু হচ্ছে। আর এটি চালুর পর বছরে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। এরই মধ্য দিয়ে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার নতুন যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ক্রুড অয়েল নিয়ে আসা জাহাজটি মাতারবাড়ি এলাকায় সাগরে নির্মিত ম্যুরিংয়ে যুক্ত করা এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল সরবরাহ কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন বলে নিশ্চিত করেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত।
মো. শরীফ হাসনাত বলেন, ‘২৪ জুন রাতে সৌদি আরব থেকে আমদানি করা ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েলবাহী (অপরিশোধিত তেল) জাহাজ ‘এমটি হোরে’ মহেশখালীর ম্যুরিং পয়েন্টে পৌঁছায়। এরপর রোববার (২৫ জুন) দুপুরে পরীক্ষামূলক কমিশনিং করার কথা থাকলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে তা স্থগিত করা হয়। যদি সোমবার (২৬ জুন) বৈরি আবহাওয়া না থাকা তাহলে এসপিএম প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কমিশনিং শুরু হবে। পরবর্তীতে পরিশোধিত তেলের জাহাজ এলে দ্বিতীয় পাইপলাইনের কমিশনিং করা হবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পের মূল কাজের অংশ হিসেবে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর ও ৭৪ কিলোমিটার অনশোরসহ মোট ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। সাগরের তলদেশের এই পাইপলাইনের মাধ্যমে কালারমারছড়ার সোনারপাড়ায় স্থাপন করা শোর ট্যাংকে নেয়া হবে এই আমদানি করা তেল।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ এমটি হোরে সৌদি আরব থেকে ক্রুড অয়েল নিয়ে আসে। এই জাহাজে ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েল রয়েছে। জাহাজটি ২৩০মিটার লম্বা এবং গভীরতা সাড়ে ১২ মিটার। জাহাজটির ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েল সাগর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর কালারছড়ায় স্থাপিত ট্যাংকে যাবে। এরপর সেখান থেকে ১৮ ইঞ্চি চওড়া পাইপে করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে আনা হবে সে তেল। যেটা এর আগে কখনো হয়নি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এটা করেছে। এটা তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সেই প্রকল্পকে সহায়তা করার জন্য এই জাহাজকে সাগরে নির্মিত ম্যুরিং পয়েন্ট আনা এবং পাইপলাইনে সংযুক্ত করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সঙ্গে কাজ করছি।
মহেশখালীর কালারমারছড়ায় স্থাপন করা হয়েছে ৬০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত তেল ধারণে ৩টি এবং ৩০ হাজার ঘনমিটার ডিজেল ধারণ ক্ষমতার তিনটি রিজার্ভ ট্যাংক। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। এসপিএম প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। এরই মধ্য দিয়ে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার নতুন যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, বাংলাদেশে জ্বালানির তেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা চলছে। এর মধ্যে টেকসহ জ্বালানি মজুদ এবং ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসপিএম প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। মহেশখালীর কালারমারছড়ায় স্থাপিত ছয়টি ট্যাংকের মধ্যে তিনটি ট্যাংকে ক্রুড অয়েল ও বাকি তিনটিতে ডিজেল সাগর থেকে পাইপলাইনের মধ্যে এনে মজুদ হবে। এরপর পৃথক দুটি পাইপলাইনে করে সেটি চট্টগ্রামে রিফাইনারিতে চলে যাবে।
তিনি বলেন, এতদিন গভীর সাগরে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করতে সময় লাগতো ১১ থেকে ১২ দিন। এতে খরচও বেশি হতো, সময়ও বেশি লাগত। এখন এসপিএম প্রকল্পের মাধ্যমে মাত্র তিন দিনের মধ্যে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করা যাবে। আর দ্রুত জাহাজ ছেড়ে দেয়া যাবে। যার ফলে জাহাজ ভাড়া বাঁচবে এবং খরচও কমে আসবে। এতে বছরে সরকারের বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা। এটা দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এসপিএম যেভাবে কাজ করবে :
জ্বালানি বিভাগে তথ্য মতে, মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নে উপকূল থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে সিঙ্গেল পয়েন্ট ম্যুরিং (এসপিএম) স্থাপন করা হয়েছে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি আলাদা পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোডি করা হবে।
১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাইপলাইন প্রথমে নিয়ে আসা হবে কালারমারছড়ায় সিএসটিএফ বা পাম্প স্টেশন অ্যান্ড ট্যাঙ্ক ফার্মে। সেখান থেকে বিভিন্ন পাম্পের মাধ্যমে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল চলে যাবে আনোয়ারার সমুদ্র উপকূলে। সেখান থেকে আবার ৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন পাড়ি দিয়ে তেল নিয়ে যাওয়া হবে পতেঙ্গায় ইআরএলের রিফাইনারিতে। এসব পাইপলাইনে ২০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এসপিএম থেকে মহেশখালীতে এসে যেখানে পাম্প হবে, সেখানে দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত তেল থাকবে এক লাখ ২৫ হাজার টন। বাকি ৭৫ হাজার টন থাকবে ডিজেল।
যা যা হলো কালারমারছড়ায় :
কালারমারছড়ার সোনারপাড়ার প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেয়া যায়, এ প্রকল্পের শুরুতে ১৯১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেটি ৯০ একরে নেমে আসে। সেখানে তিনটি পরিশোধিত ও তিনটি অপরিশোধিত তেলের স্টোরেজ ট্যাংকসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। স্টোরেজ ট্যাংকগুলোতে আমদানি করা তেল মজুদ রাখা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণ ক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার ও অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণ ক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার। স্টোরেজ ট্যাংক ছাড়াও এই প্রকল্পের অভ্যন্তরে তিন ও দুই তলা বিশিষ্ট ১৮টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আটটি অ্যাকুমেন্টেশন ভবন, দুটি ইলেক্ট্রনিক ও একটি আবাসিক ভবন রয়েছে। বাকিগুলো ওয়ারহাউজ, ক্লাবঘর ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন।
এ ছাড়া ব্লক ভাল্ব স্টেশন, পিগিং স্টেশন, মিটারিং স্টেশন, স্কাডা, মেইন ও বুস্টার পাম্প, জেনারেটর, সিকিউরিটি সিস্টেম ও ফায়ার ভেহিকেল, ফায়ার ওয়াটার নেটওয়ার্ক, পাম্প ও ওয়াটার স্টোরেজ সুবিধাদিসহ ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম রয়েছে প্রকল্পের অভ্যন্তরে। অন্যদিকে নিরাপত্তায় ১৩টি ওয়াচ টাওয়ার, তিন তলা বিশিষ্ট দুটি গেইটি ও চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। চারপাশে রয়েছে কাঁটাতারের বেষ্টনী। বর্তমানে জার্মানি ও চীনের ৫০ জন প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন। যদিও প্রকল্পের শুরু থেকে ৫০০-৬০০ বিদেশি নাগরিক কর্মরত ছিলেন।
‘এসপিএম’ শাটডাউনের ব্যাকআপ :
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, বর্তমানে দেশে তেল রিজার্ভ ক্ষমতা রয়েছে সোয়া দুই মাসের। এসমপিএম প্রকল্প চালুর মধ্যদিয়ে আরও ১৫ দিনের সক্ষমতা বেড়ে আড়াই মাসে উন্নীত হবে। অন্যদিকে ১১ দিনের পরিবর্তে মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় তেল খালাস করা হলে বছরে সরকারের বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য বলছে, দেশের একমাত্র রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। এসপিএম প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। এরই মধ্য দিয়ে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার নতুন যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘এসপিএম প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, জরুরি শাটডাউনের ব্যাকআপ হিসেবে পরিশোধিত তেল মজুত ও সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
এ ব্যাপারে কক্সবাজার চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, বিদেশ থেকে মাদার ভেসেলে আমদানি করা তেল পতেঙ্গার ডিপোতে আনলোড করতে সময় নষ্ট হয়। এখন গভীর সমুদ্র বন্দরের কাছাকাছি এসপিএম বাস্তবায়ন হচ্ছে, এটি বিরাট গুরুত্ব বহন করে। পাশাপাশি দেশের স্টোরেজ ক্যাপাসিটিও অপ্রতুল। এ প্রকল্প চালুর মাধ্যমে বৈশ্বিক সংকটে দেশে জ্বালানির যে সমস্যা হয়, এই স্টোরেজে যদি তেল রিজার্ভ তৈরি করতে পারে সংকটকালীন সময়ে বিরাট ভূমিকা রাখবে। দামের ক্ষেত্রেও সাশ্রয় হবে।
ব্যয়ের সঙ্গে বাড়ছে মেয়াদ :
২০১৫ সালে নেয়া প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তিন দফা সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু এতেও পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় চার দফা সংশোধন করে মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। আর এতে ব্যয় বেড়েছে এক হাজার ২১৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটির মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জি টু জি ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে এসপিএম প্রকল্প। এতে বৈদেশিক সহায়তা দিচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীনে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পটির ঠিকাদারের দায়িত্বে আছেন চীনের রাষ্ট্রয়াত্ত কোম্পানি চায়না পেট্রোয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি) ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি)। এতে জার্মানি-ভিত্তিক আইএলএফ কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারস কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।