জুমবাংলা ডেস্ক : ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শৈলমারী গ্রামের সবিতা রানী অধিকারী। বিয়ে হয়েছিল একই এলাকার রাধাপদ অধিকারীর সঙ্গে। দুই যুগের সংসারে অভাব-অনটনই ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। ভাগ্যের খোঁজে এই দম্পতি একসময় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু করলেন উন্নত জাতের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল লালন-পালন। এখন এলাকায় তারা এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তাদের দেখাদেখি ওই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের অন্য পরিবারগুলোও ছাগলের খামার করতে উৎসাহিত হচ্ছে। সবিতা রানী বলেন, ‘কয় বছর আগে একটা দেশি জাতের ব্ল্যাক বেঙ্গল দিয়ে ছাগল পালা শুরু করি। এর পরে আর পিছন ফিরি তাকাতি হয়নি। এখন বড় ছাগল আছে পঁচাশিটে, আর বেশ কিছু ছানাপোনা তো রয়েছেই। প্রতিবছর তিরিশ-পঁয়তিরিশটে ছাগল বিক্রি করি। এই ছাগল থেকেই বছরে আমার আয় হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এই লাভের টাকা দিয়ে দুই মেয়েকে পড়াচ্ছি, বাড়িতে পাকা ঘর দিয়েছি।’ সারা দেশে সবিতা রানীর মতো এমন অনেকেই ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে দেখেছেন সচ্ছলতার মুখ।
ছাগল নিয়ে আমাদের একটা নেতিবাচক মনোভাব সব সময়ই আছে। অথচ এ ছাগলই বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ আত্মপরিচয়ের নতুন প্রেরণা। কারণ দেশে উৎপাদিত ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগল এখন নীরব বিপ্লবের নাম। বিশ্ব জাতিসংঘ সংস্থার তথ্যমতে, ছাগল ও মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ এবং মাংস রফতানিতে পঞ্চম। সরকারি উদ্যোগে প্রচারণা না থাকায় লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে যাচ্ছে এই স্বীকৃতিটি।
জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডিজি মো. আইনুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা ছাগল উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে। পাশাপাশি রফতানির দিকে ঝুঁকছি। মৎস্য এবং ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ। তবে ছাগল উৎপাদনে সঠিক প্রচারণা না থাকার কারণে এই সাফল্যটি আমাদের অনেকের কাছেই অজানা আছে। এ বিষয়ে অধিদফতর কাজ করছে। আশা করছি, অচিরেই মৎস্যের পাশাপাশি এটারও প্রচারণা শুরু হবে। যাতে এই সেক্টরে দেশের মানুষ উৎসাহিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে জানি। তবে ছাগল উৎপাদনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের স্বীকৃতি রয়েছে এটা নতুন জানলাম। কারণ বিশ্ব সংস্থাগুলো বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা এবং অর্জনগুলো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাই প্রচার-প্রচারণা থাকলে সে সম্পর্কে মানুষ দ্রুত অবগত হয়। তবে ছাগল উৎপাদনে এত বড় সাফল্য তা হয়তোবা কর্তৃপক্ষের প্রচার না থাকায় মানুষের নজরের বাইরে রয়েছে। আশা করি, সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে সুনজর দেবেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জানান, মাছে-ভাতে বাঙালি। এ যেন চিরায়ত বাংলার প্রকৃত রূপ। তাই এ নিয়েই চলে সব আলোচনা। ফলাও করে চালানো হয় প্রচার। কারণ মানুষের আমিষের পুরো চাহিদা পূরণ হয় নদীমাতৃক বাংলাদেশের এ খাত থেকে। মৎস্য সপ্তাহ পালনসহ এই সেক্টরকে নিয়ে চলে হইচই। তবে মাংস মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর করে। এ নিয়ে প্রচারণা থাকা উচিত। কিন্তু ফল উল্টো। মৎস্য নিয়ে যত সরব ততটাই প্রচারণায়বিমুখ খোদ মন্ত্রণালয় প্রাণিসম্পদ ইস্যুতে। তা না হলে জাতিসংঘের রিপোর্টে মৎস্য এবং ছাগল উৎপাদন দুটিতেই বাংলাদেশ চতুর্থ হলেও একটি নিয়ে ফলাও করে প্রচার করা হয়, অন্যটি নিয়ে কেন নয়; প্রশ্ন রাখেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশে এখন ছাগল রয়েছে আড়াই হাজার কোটির বেশি। ক্রমান্বয়ে এ সংখ্যা বাড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও ঝিনাইদাহের পাশাপাশি সাতক্ষীরা অঞ্চলেও ছাগল পালনের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। হাউস ম্যাকারদের (গৃহিণী) কাছে হাত খরচের চাহিদা মিটে থাকে এই ছাগল পালন এবং তা বিক্রির অর্থের মাধ্যমে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, পালিত ছাগলের বেশির ভাগই ব্ল্যাক বেঙ্গল। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটি একটি রেকর্ড। গত পাঁচ বছরে উৎপাদিত ছাগলের সংখ্যা ৬০ লাখ। তবে গ্রামের অতি-সাধারণ ঘরের মানুষ বাড়তি মুনাফার আশায় ব্ল্যাক বেঙ্গলের সঙ্গে অন্য জাতের ছাগলের সংকরায়ণ করার নজির খুবই কম। ফলে বিশ্বের হাতে গোনা যে চার থেকে পাঁচটি জাতের এখনো সংকরায়ণ হয়নি, সেগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র জাত হিসেবে টিকে আছে ব্ল্যাক বেঙ্গল। তাদের এক তথ্যে জানা গেছে, সারা দেশে ছাগল পালিত হচ্ছে দুই কোটি ৫৪ লাখ ৩৩ হাজার। দেশের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি ছাগল পালিত হচ্ছে। তবে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলায় বেশি পালিত হয়। পিছিয়ে নেই সাতক্ষীরাসহ অন্য বেশ কটি জেলা। কারণ কম পরিশ্রমে বেশি মুনাফা হওয়ায় এর দিকে ঝুঁকছেন অনেকেই।
জানা যায়, বিশ্বে ছাগল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে নিয়ে প্রায় একযুগ ধরে কাজ করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা ‘এফএও’ এবং আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা কেন্দ্র (আইএইএ)। সংস্থা দুটির সর্বশেষ মূল্যায়নে, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।
২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থা দুটি বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপর গবেষণা করে নিজস্ব এই জাতকে অন্যতম সেরা জাত হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। সংস্থা দুটির ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্য ৯৯টি জাতের সব ধরনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলই সবার সেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের পাশাপাশি রাম-ছাগলেরও জনপ্রিয়তা রয়েছে দেশে। এই ছাগলের উচ্চতাও ভালো। এমনকি পুষ্টিগুণের দিক থেকে এই জাতের ছাগলের দুধ সুস্বাদু এবং খুবই মিষ্টি। ফলে দিনে দিনে এর চাহিদাও বাড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর গ্রামের আ. রহিম বলেন, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের পরিচিতি থাকলেও আমাদের এখানে রাম-ছাগল সবার কাছেই পরিচিত। এক বছর আগে খুলনা থেকে তিনটি এই জাতের ছাগল কিনে এনেছিলাম। এটি বছরে দুবার বাচ্চা দিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে ছাগলের সংখ্যা ৫টি হলেও সম্প্রতি তিন মাসের একটি বাচ্চা ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আর এ জাতের ছাগল থেকে দিনে দুবারে প্রায় এক কেজি দুধ পাওয়া যায়। খরচ কম এবং আয় বেশি হওয়ায় এদিকে ঝুঁকেছেন বলে জানান তিনি। তবে শ্যামনগরের বাঁধঘাটা এলাকার আফজাল শেখ অনেক আগে থেকেই এই ছাগল পালন করছেন বলেও জানান আ. রহিম বাবু। তার ঘরে এখন ২৫ থেকে ৩০টি বিভিন্ন জাতের ছাগল রয়েছে। সূত্র : প্রতিদিনের সংবাদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।