জুমবাংলা ডেস্ক : চলতি বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ০৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয়ার আগে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থবিরতার সুযোগে রাজনৈতিক হামলার ঘটনা বেড়ে যায়। সে সময় সংখ্যালঘুরাও আক্রান্ত হন। তবে বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার সে সময় অনুসন্ধান করে দেখে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাজনৈতিক পরিচয় বা আক্রোশের বশবর্তী হয়েও সে সময় এমন অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে প্রচার করা হয়েছে। এসব প্রচারে বড় ভূমিকায় ছিল ভারত থেকে পরিচালিত এক্স অ্যাকাউন্ট এবং ভারতীয় বেশ কিছু গণমাধ্যম। মূলত এভাবেই শুরু ভারতীয়দের অপতথ্যের বন্যা।
রিউমর স্ক্যানারের ইনভেস্টিগেশন ইউনিট ০৫ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে (সাবেক টুইটার) এমন ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করেছিল, যেগুলোতে বাংলাদেশের আগস্টের ঘটনাবলির বিভিন্ন ছবি, ভিডিও এবং তথ্যকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হয়। এসব অ্যাকাউন্টের প্রতিটির অন্তত একটি পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছিল রিউমর স্ক্যানার। এসব অ্যাকাউন্টে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে প্রচারিত উক্ত পোস্টগুলো ১ কোটি ৫৪ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে। আরও একাধিক অ্যাকাউন্ট এবং ভারতীয় গণমাধ্যমের কল্যাণে এসব অপতথ্য সে সময় ১০ থেকে ১২ গুণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল বলে অনুমান করে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ভুয়া এবং অপতথ্য ছড়ানো এসব অ্যাকাউন্টধারীর ৭২ শতাংশই ভারতে থাকেন বলে উল্লেখ করেছেন। অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে দায়িত্বশীল অনেক ব্যক্তিও রয়েছেন। এমনকি ভারতের একাধিক মূল ধারার গণমাধ্যমেও এসব ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়। এই অপতথ্যের বন্যা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তা ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিভিন্ন দেশের সুপরিচিত দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বরাও (যেমন, ইরাকি বংশোদ্ভূত সালওয়ান মোমিকা, পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক লেগ স্পিনার দানিশ কানেরিয়া) এসব দাবি প্রচার করেছেন।
ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের প্রচার নতুন নয়। তবে গণঅভ্যুত্থান পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যুতেও ভুল তথ্যের প্রচার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়িয়ে ভারতের গণমাধ্যমে পৌঁছে গেছে।
যেমন, ভারতের একাধিক গণমাধ্যম আগস্টে দাবি করে যে, বাংলাদেশে বেশ কিছু নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে যে দাবিটি মিথ্যা।
এরপর দিন পেরিয়েছে, অপতথ্যের ভয়াবহতা কমলেও একেবারে বন্ধ ছিল, এমন বলা যাবে না। পরবর্তী কয়েক মাসে নিয়মিতই একই অ্যাকাউন্টগুলোসহ আরও একাধিক অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্যের প্রচার করে গেছে। এসবের মধ্যে সাম্প্রদায়িক অপতথ্যই ছিল বেশ লক্ষ্যণীয়।
সনাতন ধর্মাবলাম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই কমবেশি সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার থেকে শুরু করে অপতথ্য, ভুল তথ্য এবং সর্বোপরি গুজব প্রচারের হার বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। চলতি বছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। রিউমর স্ক্যানার ভারতীয় এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত এমন দুইটি দাবি যাচাই (১, ২) করেছে, যেগুলো অন্তত সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে।
অপতথ্যের এই প্রবাহে অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়েও নিয়মিত ভুয়া তথ্যের প্রচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি শামিল হয়েছিল ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। ড. ইউনূসের শারীরিক অসুস্থতা কিংবা ট্রাম্পের জয়ে ড. ইউনূস দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন শীর্ষক ভুয়া দাবিগুলো রীতিমতো ফলাও করে প্রচার করেছে ভারতের গণমাধ্যম। উপরন্তু, একটি দাবি সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, যেখানে আবদুল্লাহ আল মাহফুজ নামে একজন ব্যক্তি, যিনি ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাকে উপদেষ্টা মাহফুজ বলে মিথ্যা দাবি করা হয়েছিল। রিউমর স্ক্যানার পরবর্তীতে নিশ্চিত করে যে দুজন ব্যক্তি আলাদা।
এর মধ্যে ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ শহীদ নূর হোসেন দিবস পালনের ঘোষণা দিলে এই কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার পর এক হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন শীর্ষক একটি দাবি ভাইরাল হয় এক্সের অসংখ্য অ্যাকাউন্টে। বিস্ফোরকের মতো ছড়িয়ে পড়া এই দাবি সম্বলিত পোস্টগুলো প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায় সে সময়। আদতে এমন কিছুই ঘটেনি বলে প্রমাণ পায় রিউমর স্ক্যানার।
এ ছাড়া, নভেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পাকিস্তানের জাহাজ আসার ভুয়া দাবি করে রিপাবলিক বাংলা নামে ভারতের একটি চ্যানেল।
আগস্ট পরবর্তী সময়ে ভারতীয়দের দ্বারা সবচেয়ে বড় অপতথ্যের বন্যা ফের শুরু হয় নভেম্বরের শেষ নাগাদ। ২৫ নভেম্বর জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন তাকে চট্টগ্রামে আদালতে হাজির করা হলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরই প্রেক্ষিতে আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের হটাতে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন একদল আইনজীবীও। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। তখন সাইফুল ইসলাম নামের এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরব হয় ভারতের মিডিয়া ও এক্স অ্যাকাউন্টগুলো।
ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম এবং এক্স অ্যাকাউন্টগুলো রীতিমতো এই ইস্যুতে অপতথ্যের ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আগস্টে রিউমর স্ক্যানার যে এক্স অ্যাকাউন্টগুলো চিহ্নিত করেছিল, সেগুলো এবারও নেতৃত্ব দিচ্ছে এক্সের এই অপতথ্যের বন্যায়। এটা বেশ শঙ্কার। এদের ফলোয়ার বা অনুসারী বিপুলসংখ্যক। দাবানলের মতো এদের পোস্ট ছড়াচ্ছে ইন্টারনেটে।
০৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি সমন্বিত বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার উদয় ঘটে, যা মূলত হিন্দুত্ববাদী এক্স অ্যাকাউন্টগুলোর দ্বারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণার মাধ্যমে চালিত হয়। তাদের পদ্ধতিতে একটি স্বতন্ত্র প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যেতে পারে; যার মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আক্রান্তের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক ঘটনা দাবি, রাজনৈতিক সহিংসতাকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসেবে দেখানো, আক্রান্ত হওয়া মুসলিম বা তাদের সম্পত্তির ভিডিওকে হিন্দুদের ওপর হামলার হিসেবে প্রচার, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানকে একটি জঙ্গি বা ইসলামিক শাসনের উত্থান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গণধর্ষণ ও হত্যার দাবি উল্লেখযোগ্য।
ব্যাপারটি এমন দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে যে যখনই কোনো হিন্দু ব্যক্তি কোনোভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন বা কোনো ভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তখনই ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি ঘটনাটি রাজনৈতিক বিরোধ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা অন্যান্য অ-ধর্মীয় উদ্দেশ্য থেকে উদ্ভূত হলেও। বিশেষত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরবর্তী সময়ে দলটির নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক এবং জনতার ক্ষোভে পড়ে হামলার শিকার হন। এসব ঘটনার অনেকগুলোকেই সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।
উল্লেখ, এই অপতথ্যের প্রচার শুধু ভারতের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল, এমন বলা যাবে না। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও এই প্রবাহে অবদান রেখেছে। তাদের রিপোর্ট; যা প্রায়ই অতিরঞ্জিত বা বিভ্রান্তিকর হওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেটের জন্য তথ্যের সূত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই পরিষদ নয়টি সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের দাবি করে। নেত্র নিউজের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই দাবিকে অসত্য বলা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মৃত্যুর কোনো ঘটনাই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এর পরিবর্তে, সাতটি ঘটনাকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, জনতার সহিংসতা বা অপরাধমূলক বিরোধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল।
রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগস্টে এই অপতথ্যের বন্যার মধ্যে ৫৯টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। পরের দুই মাসে তা কমে আসলেও (সেপ্টেম্বরে চারটি, অক্টোবরে ৭টি) নভেম্বর তা আবার বৃদ্ধি পায়। রিউমর স্ক্যানার নভেম্বরে ৩১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে। চলতি মাসের (ডিসেম্বর) ১০ তারিখ পর্যন্ত ১৯টিসহ এই সময়কালে সর্বমোট ১২০টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এসব অপতথ্যের প্রবাহে নাম লিখিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমও। এমন ৪৯টি গণমাধ্যমের তালিকা প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার, যারা কিনা গত ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ১৩টি ভুয়া খবর প্রচার করেছে।
গণমাধ্যমের পাশাপাশি ভারতসহ একাধিক দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও অপতথ্যের এই প্রবাহের প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন। এই তালিকায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্তত দুইজন রাজনীতিবিদ (শুভেন্দু অধিকারী, অগ্নিমিত্রা পাল), পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার দানিশ কানেরিয়া, সুইডেনে একাধিকবার কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় অভিযুক্ত সালওয়ান মোমিকা, দীর্ঘদিন ধরে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখক তসলিমা নাসরিন, ভারতীয় গণমাধ্যম অপি ইন্ডিয়ার সম্পাদক নুপুর শর্মার মতো ব্যক্তিত্বরা রয়েছেন।
রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণ বলছে, এক্সে আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে ছড়ানো অপতথ্যগুলো দেখা হয়েছে অন্তত ২০ কোটি বার। এর মধ্যে একটি পোস্টই ১ কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে। এসব অপতথ্য গণমাধ্যমের সামাজিক প্লাটফর্ম ছাপিয়ে প্রচার হয়েছে টেলিভিশন এবং প্রিন্ট সংস্করণেও। এর ফলে অগণিত মানুষের কাছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ক্রমাগত ভুল তথ্য সম্বলিত বার্তা গিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশ ও ভারত এই দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হওয়া অমূলক নয়। দুই দেশের নিরাপত্তার জন্যও এটি শঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে। রিউমর স্ক্যানার আশঙ্কা করছে, সামনের দিনগুলোয় অপতথ্যের প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।